“ব্ল্যাকহোল পরিচিতি”
রহস্যের মায়াজালে ঘেরা এক অদ্ভুত নাম “ব্ল্যাকহোল”। যা নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতুহলের শেষ নেই। “ব্ল্যাকহোল” নামের সাথে বর্তমান সময়ে কমবেশি সকল বিজ্ঞান পাঠকরাই পরিচিত।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখকদের কাছে এ তো এক অবশ্য লেখ্য বিষয়। লাইব্রেরিতে এ বিষয় নিয়ে আজকাল অনেক বইও পাওয়া যাবে হাতের নাগালে। তবে আমাদের মধ্যে যারা নতুন পাঠক, যারা ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে খুব একটা জানেন না, আজকের “রহস্যের আরেক নাম ব্ল্যাকহোল” আর্টিকেলের ১ম পর্ব “ব্ল্যাকহোলের পরিচয়” টপিকটি শুধুমাত্র তাদের জন্যই।
‘ব্ল্যাকহোল’- নামটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তার অফুরন্ত রহস্য। ইংরেজি শব্দ Black Hole, বাংলায় যার অর্থ গিয়ে দাঁড়ায় কৃষ্ণগহ্বর। কৃষ্ণ মানে কালো আর গহ্বর মানে গর্ত। কালো গর্তের মতো দেখতে এমন কোনো কিছুই কি তাহলে ব্ল্যাকহোল? অনেকের মনে এরকম প্রশ্নের উদয় হতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে এমনই মনে হয় আর কি! কিন্তু ব্ল্যাকহোল এমন এক রহস্যময় জিনিস যা কিনা রহস্যময়তার আড়ালেই নিজেকে লুকিয়ে রয়েছে, ঢেকে রেখেছে অদৃশ্যতার চাদরে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, মহাজাগতিক বস্তুর মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে চমকপ্রদ তার নামই হলো ব্ল্যাকহোল। স্পেস-টাইমের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল যেখানে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এতটাই প্রবল যে, কোনো কণা এমনকি তাড়িতচৌম্বক বিকিরণ যেমন: আলো পর্যন্ত সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না এমন কোনো কিছুই হচ্ছে ব্ল্যাকহোল।
১৯৬৭ সালে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পদার্থবিদ জন হুইলার সর্বপ্রথম ব্ল্যাকহোল নামকরণ করেন। তবে এর অনেক আগেই, ১৭৮৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন মিশেল “Philosophical Transaction of the Royal Society of London” নামক পত্রিকায় “ডার্ক স্টার” শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রদান করেছিলেন। তার এই গবেষণাপত্রের মাধ্যমেই মুলত সর্বপ্রথম ব্ল্যাকহোলের ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। মহাকাশের ‘ বার্মুডা ট্রায়াংগেল ‘ খ্যাত এই ব্ল্যাকহোল মানুষের কোনো ইন্দ্রিয়ানুর সাহায্যে সরাসরি দেখা যায় না।
এছাড়াও বিজ্ঞানীদের কাছে এটির সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং একই সাথে কৌতূহলের দিক হচ্ছে যে, ব্ল্যাকহোলে তথাকথিত পদার্থবিজ্ঞানের সকল সূত্রই অকেজো। কি এমন জিনিস যেখানে পদার্থবিজ্ঞানের কোনো সূত্রই কার্যকর হয় না? এরকম কোনো কিছু কি আদৌ সম্ভব? সত্যিই কি ব্ল্যাকহোল নামে কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে আমাদের এই মহাবিশ্বে? এরকম প্রশ্ন করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রথম পর্যায়ে সকল গবেষক বা বিজ্ঞানীদের মনেও এমন অজস্র প্রশ্ন উঁকি মেরেছিল। সেই প্রশ্নগুলোর অনুসন্ধান আর গবেষণা থেকেই জন্ম হয়েছে আজকের সুপ্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব ব্ল্যাকহোলের।
বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাকহোলের মাত্র তিনটা রাশি সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে সক্ষম হয়েছেন। রাশিগুলো হচ্ছে ভর, ব্ল্যাকহোলের বৈদ্যুতিক চার্জ বা আধান এবং এর স্পিন বা ঘূর্ণন অর্থাৎ এটি কোন দিকে কত বেগে আবর্তিত হচ্ছে। জানা গেছে, ব্ল্যাকহোলের ভর ও ঘনত্ব হচ্ছে অসীম কিন্তু আয়তন খুবই কম। আয়তন কম হওয়া সত্ত্বেও কোটি কোটি টন ভরের কোনো বস্তুকে সহজেই ধারণ করতে পারে এই ব্ল্যাকহোল।
ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে একটি প্রচলিত তথ্য হচ্ছে যে, এখান থেকে কোনো কিছুই বের হয়ে আসতে পারে না। এখানে কোনো বস্তু পতিত হলে সেটা আর কখনো সেখান থেকে বের হতে পারে না।এমনকি আলো পর্যন্তও এখান থেকে বের হয়ে আসার ক্ষমতা রাখে না। আমরা জানি, বাহ্যবস্তু থেকে আলো যখন আমাদের চোখে এসে পড়ে তখনই কেবল আমরা বস্তুটা দেখতে পাই।এখন যদি কোনো বস্তু এমন হয় যে, বস্তুটা থেকে আলোই বের হয়ে আসতে পারছে না তাহলে কিভাবে বস্তুটা দেখা সম্ভব হবে? বেধে গেল রহস্যময়ীর রহস্যের জট। এ কেমন জট, ভাবতে ভাবতে বিজ্ঞানীরা পৌঁছে গেল আলবার্ট আইনস্টাইনের স্থান কালের বক্রতার ধারণায়।
ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এত বেশি শক্তিশালী যে সে তার চারপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়।তীব্র মহাকর্ষীয় বলের কারণে আলোও এর মধ্যে বাঁধা পড়ে যায়।ব্ল্যাকহোলের ভিতর কোনোকিছুই স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে না। সবকিছু গতিশীল অবস্থায় থাকে বলেই কোটি কোটি টন ভরের বস্তু থেকে শুরু করে আলো পর্যন্তও এখানে থেকে বের হয়ে আসতে পারে না।
এতদিন পর্যন্ত ব্ল্যাকহোলের অনেক কাল্পনিক চিত্র এঁকেছিলেন অনেক চিত্রশিল্পী কিংবা অনেক এনিমেশন ক্রিয়েটররা।তবে সত্যিকারের ব্ল্যাকহোলের সন্ধান ইতিমধ্যেই বিজ্ঞানীরা পেয়ে গেছেন। সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত ব্ল্যাকহোলের নাম হচ্ছে Cygnus X-1.২০১৯ সালের এপ্রিলে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের সাহায্যে গ্যালাক্সি এম-৮৭-এর কেন্দ্রে থাকা কৃষ্ণগহ্বরের ছায়া থেকে বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাকহোলের ছবি তৈরি করতে সমর্থ হন। বিশ্বজুড়ে ব্যাপক উৎসাহের জন্ম দিয়েছিল সেই ছবি। এরই হাত ধরে ২০২০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের মূল বিষয়—ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর।
২০২০ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়র অধ্যাপক রজার পেনরোজ, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ফিজিকস ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির অধ্যাপক রাইনহার্ড গেনজেল এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসের অধ্যাপক আন্দ্রিয়া গেজ।
কৃষ্ণগহ্বরের আধুনিক গাণিতিক তত্ত্বের মূল উৎস আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব। যদিও আইনস্টাইন নিজে কৃষ্ণগহ্বরের ফ্যান ছিলেন না, কিন্তু আইনস্টাইনের মৃত্যুর ১০ বছর পর ১৯৬৫ সালে ব্ল্যাকহোলসংক্রান্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং সবচেয়ে ক্ল্যাসিক গাণিতিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানী রজার পেনরোজ।
পরিশেষে, ব্ল্যাকহোল হচ্ছে মহাবিশ্বের ভয়াল কালো দানব যাকে নিয়ে রহস্যের কোনো শেষ নেই। বিজ্ঞানীরা একের পর এক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্ল্যাকহোল নিয়ে। সূদুর ভবিষ্যতে হয়তো মানুষ চাঁদে যাওয়ার মতো ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজোনেও পৌছেও যাবে। কিন্তু ব্ল্যাকহোল যে সত্যিই একটি জটিল, অফুরন্ত রহস্যের আধার এবং বিজ্ঞান জগতের সবচেয়ে চমকপ্রদ বস্তু এ বিষয়ে মনে হয় না কারো কোনো দ্বিমত থাকবে।
মো: সাওম আল ইরাম
শিক্ষার্থী, এসএসসি পরীক্ষার্থী,শহীদ সমৃতি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মধুপুর, টাংগাইল।
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ফেসবুক ক্লিক করুন
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ইউটিউব ক্লিক করুন
[শিশুরাই তুলে ধরবে শিশুদের অধিকারের কথা, আপনিও লিখুন আপনার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]]
Comments are closed.