কষ্টে ভরা আমার গর্ভধারিণী মা সুফিয়া বেগমের জীবন। স্বামী হারা ৩৬ বছর বয়সী মা ঢাকার একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক। মধ্যবিত্ত নানার পরিবারে তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় আমার মা। তার ১২ বছর বয়সে মারা যান আমার নানী।
পরিবারের বড় হওয়ায় সব কাজ তাকেই দেখভাল করতে হতো সেসময়। দ্বিতীয় বিয়ে করেন আমার নানা, যা হয় আরকি। এতে সুখের বদলে আরও দুঃখ বাড়ে। যত দিন যায়, তত বাড়ে অশান্তি।
বড় মেয়ের সুখের কথা মাথায় রেখে নিজ গ্রামেই এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন তার বাবা (আমার নানা)। সেখানে সুখেই দিন কাটছিল পরিবারটির। ওই সুখের সংসারের মাঝেই আমার আগমন। এরইমধ্যে চলে আসে পরিবারের নতুন অতিথি-আমার ছোট্ট বোন। ছেলে-মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে সুখেই দিন কাটছিলো মায়ের। কিন্তু সুখ স্থায়ী হয়নি বেশি দিন। হঠাৎই আমার বাবার ব্রেইনে সমস্যা দেখা দেয়। দিন দিন অবস্থার অবনতি হতে থাকে। কাজ-কর্ম না করতে পারায় সংসারে নেমে আসে দুঃখের জোয়ার। বাবার মাথার সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলে। বিভিন্ন ঘটনায় মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।
এক পর্যায়ে বাবার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পাগলের মতো হয়ে পড়েন। সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। কখনো বাড়িতেই ফিরতেন না। এদিকে সংসার আর চলে না। খাবারের জন্য আমাদের কান্নাকাটি করেতে দেখে মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। কিন্তু এভাবে চলে না। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ২০০৮ সালের মাঝামাঝি আমাদেরকে আমার দাদা বাড়ি রেখে (আমি তখন ২য় শ্রেণিতে পড়ি এবং ছোট বোনের তখনো স্কুলে ভর্তির বয়স হয়নি) উপার্জনের জন্য ঢাকা শহরে পাড়ি দেন মা। অল্প বেতনে পোশাক শ্রমিক হিসেবে চাকরি নেন গার্মেন্টসে।
২০১১ সালের শুরুর দিকে আমার বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমার বয়স ১০ বছর। ৫ম শ্রেণিতে পড়ি তখন। ছোট বোন ২য় শ্রেণিতে। আমাদের আকড়ে থাকেন মা। আমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এবং জীবন গড়ার কথা ভেবে আর কখনো বিবাহ নামের শব্দটির সঙ্গে নিজেকে জড়াননি এ নারী। সন্তানদের নিয়েই সুখে দিন কাটাতে চাইলেন। ঢাকায় চাকরি করে আমাদের সব ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার খরচ চালান তিনি। এক যুগ পেরিয়ে গেলো মায়ের এই সংগ্রামের।
আমি কলেজে লেখাপড়া করছি। ছোট বোন গ্রামের বাড়িতে মহিলা ক্বওমী মাদ্রাসায় পড়ে। এই সংগ্রামী নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করে আমি গর্বিত। জীবনযুদ্ধে একজন লড়াকু সৈনিক তিনি। প্রার্থনা করি আমার লড়াকু মাকে সৃষ্টিকর্তা শান্তিময় জীবন দান করুক। আর আমি যেন আমার উপার্জিত অর্থে তার সেবা করতে পারি।
লেখক: মো: সোহেল রানা
শিক্ষার্থী, উত্তরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
Comments are closed.