নেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভীড়। দখল হয়েগেছে জায়গা। মাছের চালায় মাছ নেই, তরকারির চালায় তরকারি। চাউলের হাটিতে উঠে না চাউল ডাউলের হাটিতে ডাউল। জবহ হয় না গরু ছাগল। উঠে না ধান গম রবিশষ্য। বিকিকিনি নেই পাটের হাটিতে।
স্বর্বত্র যেন ক্রেতাশূণ্য শশ্মাণ নিরবতা। হাটটি হারিয়েছে তার যৌবনের চীর চেনা রূপ। গুটি কয়েক হাটুরে তাদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে হাটটির অস্তিত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন মাত্র। কিন্তু, একদিন এমন করুণ অবস্থা ছিল না জামালপুরের ঐতিহ্যবাহী রাণীগঞ্জ বাজার হাটের।
জামালপুর ও তার আশ পাশের এলাকা ছাড়াও ময়মনসিংহ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জসহ পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমাগত ঘটত এই হাটে। হাটের ঘাটে ভীড়তে শত শত মণ বোঝায় ধান পাট চাল গম বিভিন্ন শয্য ও সবজিবাহী নৌকা বহর। সকাল থেকে রাত অবদি চলত বিকিকিনি। হাটের দিন শনি মঙ্গলবার হতো লোকলোকারণ্য। মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যেতো মানুষ। এই হাটকেই ঘিরে গড়ে উঠেছিল জামালপুরের অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক কর্মকান্ড।
কারও কারও মতে হাটটির বয়স কয়েকশ বছর। তবে, ভূমি জরীপ সিএসসূত্রে জানা যায়, ১৯১৩ সালে অবিভক্ত ভারতের নাটোরের রাণী দেবী চৌধুরাণী তার নাম অনুসারে প্রায় ১০ একর জায়গাজুড়ে এই হাটটি স্থাপন করিয়েছিলেন।
জানা যায়, হাটটি স্থাপনের পর থেকে বিংশ শতাব্দীর শেষ (২০০০) সাল পর্যন্ত এই হাটটি ছিল এই অঞ্চলের বড় বাণিজ্যিককেন্দ্র। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে হাটটি স্থাপিত হওয়ায় জামালপুর ছাড়াও ময়মনসিংহ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জসহ পাবনা সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও রংপুর দিনাজপুরের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমাগত ঘটত এই হাটে। জলপথে পণ্য আনা নেওয়া সহজ হওয়ায় হাটের ঘাটে ভীড়ত শত শত মণ বোঝায় ধান, পাট, চাল, গম বিভিন্ন শয্য ও সবজিবাহী নৌকার বহর। সকাল থেকে রাত অবদি চলত বিকিকিনি। এই হাটে আসত মুন্সিগঞ্জের আলু, পাবনার পেঁয়াজ রসুন, সিরাজগঞ্জের গুড় ও শাড়ি কাপড় লঙ্গি, রংপুর দিনাজপুরের তামাক পাতা। এই হাট থেকে ময়মনসিংহ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে যেতে পাট ধান মরিচ, বেগুন সরিষা ও নানা রবিশষ্য। বিশেষ করে এই অঞ্চলের পাটের জন্য এই হাটটি ছিল বিখ্যাত। বাংলাদেশের উৎপাদিত পাটের গুণগত মানের দিক থেকে জামালপুর পাট ছিল দ্বিতীয় স্থানে। আর সেই পাট ক্রয়-বিক্রয় হতো এই হাটে। ওই সময়ে অনেক সরকারি বেসরকারি পাট ক্রয় এজেন্সি গড়ে উঠেছিল এই হাটে।
হাটের পাশে বসবাসকারী পুরাতন পাট ব্যবসায়ি মরহুম সিরাজুল ইসলামের ছেলে পিপলু (৬৫) জানান, আজকের আধুনিক জামালপুরের বাণিজ্যিক ভীত্তি ছিল এই হাট। এই হাটকে কেন্দ্র করেই জামালপুরে বাণিজ্যি কর্মকা- সম্প্রসারিত হয়েছে। নানা কারণে আজ হাটটি তার চীর চেনা রূপ ও যৌবন হারিয়েছে। কার্যতঃ আজ এর কোনো সক্রিয়তা নেই। মাছের বাজারে মাছ নেই, মাংসের বাজারে মাংস। উঠে না ধান চাল। ব্যস্ততম পাটের হাটিতে কোনো ক্রেতা-বিক্রেতা নেই। যেন শশ্মণ ঘাট। গুটি কয়েকজন পান সুপারী বিক্রেতা আর কয়েকজন কামার ও সূই সুতার দোকানদার হাটের নামকে বাঁচিয়ে রেখেছেন মাত্র।
রাণীগঞ্জ বাজার হাটের একজন প্রবীণ মুসল্লা ব্যবসায়ী শাহাজাহান মিয়া (৭০) বলেন, আশে পাশে এলাকার মানুষের কাছে হাটের দিন ছিল উৎসবের মতো। নানা পণ্যের মেলা বসত হাটের দিনে। থাকত ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপচে পড় ভীড়। হাটের প্রবেশদ্বারে ঢুকা বের হওয়া ছিল যুদ্ধের মতো। এই হাটকে কেন্দ্র করেই হতো ইষ্টি আলাপন। লেন দেনের তারিখ ধার্য্য হতো হাটের দিনকে হিসাব করে। কিন্ত, ২০০০ সালের গোড়ার দিকে হাটটি ম্লান হতে শুরু করেছে। তৎকালিণ ইজারাদারদের সেচ্ছাচারিতা, যত্রতত্র হাট বাজার গড়ে উঠা ও নদীপথ শুকিয়ে যাওয়া কারণে আগের মতো দূর দুরান্তের ক্রেতা-বিক্রেতারা আসে না এই হাটে।
হাটে পণ্য ক্রয় করতে আসা গ্রাহক মুকুল মিয়া (৫৫) বলেন, আমি এই হাটের আমি একজন নিয়মিত ক্রেতা। ছোট বেলা প্রতি হাটেই বাবার সাথে সদাই কিনতে আসতাম। তখন মানুষে ভীড়ে হাটে ঢুকা যেত না। বাবা আমাকে এক হাতে শক্ত করে ধরে আরেক হাতে ভীড় ঠেলে হাটে ঢুকতেন। আজ আমার সময়ে এসে বাবাও মারাগেছেন হাটটি মারা গেছে।
জামালপুর রাণীগঞ্জ বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ী, জামালপুর চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি, রঞ্জন কুমার সিংহ (৫৫) বলেন, জামালপুর ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা রাণীগঞ্জ হাটে ধান পাট সরিষা মরিচ বিক্রি করে সেই টাকায় বাড়ির জন্য কাঠ,টিন, লোহা ও স্ত্রী সন্তানদের জন্য কাপড় চোপড়, চাষের জন্য সার, তেল, বীজ এবং বাচ্চাদের জন্য মিষ্টি দই রসমলাই কিনতেনই। এভাবে হাটকে ঘিরে এর চারপাশে বাণিজ্যিক কর্মকা- সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু, সময়ের চাহিদা, যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন ও সুযোগ সুবিধা মানুষের দ্বোগোড়ায় পৌছে যাওয়ায় জামালপুরের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র ঐতিহ্যবাহি হাটটি আজ ম্লান।
এ ব্যাপারে জামালপুর পৌর মেয়র ছানোয়ার হোসেন ছানু বলেন, এই হাটের আমরাও একজন পুরাতন ব্যবসায়ী। হাটটির সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িত। তবে, আমি নির্বাচিত হয়েছি সবে মাত্র। হাটটির রক্ষাকল্পে খুব শিঘ্রই একটি কমিটি গঠণ পরবর্তী সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা আশু সমাধানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, ইনশা আল্লাহ। সূত্র: জামালপুর চিত্র
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ফেসবুক ক্লিক করুন
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ইউটিউব ক্লিক করুন
[শিশুরাই তুলে ধরবে শিশুদের অধিকারের কথা, আপনিও লিখুন আপনার কথা। লেখার পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]]
Comments are closed.