নেদারল্যান্ডসের মানুষ প্রয়োজনীয় কাজ থেকে শুরু করে ভ্রমণের ক্ষেত্রেও সাইকেলকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে, নেদারল্যান্ডসে নাকি ২২ মিলিয়নের মতো সাইকেল রয়েছে, যেখানে দেশের জনসংখ্যাই ১৭ মিলিয়নের কাছাকাছি!
বিশাল সংখ্যক সাইকেল সামাল দিতে সেখানে সাইকেলের জন্য আছে আলাদা রাস্তা, ট্রাফিক ব্যবস্থা, টানেল, ব্রীজ, এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাইকেল পার্কিং গ্যারেজ।
সাইকেলের দেশ হয়ে ওঠার গল্পও যে সবসময় এক ছিল তা-ও না। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের দুই দশক এবং গত শতকের সত্তর-আশির দশকের বিভিন্ন ঘটনা নেদারল্যান্ডসে সাইকেলের প্রসার প্রচুর পরিমাণে বাড়িয়ে দেয়। প্রথমে নজর দিতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরের সময়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রতিটি দেশই পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। নেদারল্যান্ডসও ব্যতিক্রম নয়। ঠিক এ সময়েই সাইকেলের জায়গা নিতে শুরু করে গাড়ি। যেহেতু তখন তাদের ক্রয়ক্ষমতা ছিল বেশি, তাই তারা যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গাড়িকে প্রাধান্য দিতে লাগল।
গাড়ি চলার সুবিধার্থেই নতুন নতুন রাস্তা তৈরি ও আগের রাস্তাগুলোর সংস্কারকাজ শুরু হলো। এমনকি আগে সাইকেলের জন্য যে পথগুলো ছিল, সেগুলোও ভেঙে গাড়ি চলার রাস্তা বানানো শুরু হয়। আর সাইকেল যেন আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যেতে থাকে।
গাড়ির সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনার হার। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭১ সালে ৩,০০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়, যার মধ্যে ৪০০ জনেরও বেশি শিশু। এই মৃত্যুহার, বিশেষ করে শিশুমৃত্যু মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সূচনা হয় ‘স্টপ দে কিন্ডারমুর্ড’ আন্দোলনের।
মূলত ১৯৭২ সালে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের লক্ষ্যই ছিল গাড়ি দুর্ঘটনায় শিশুমৃত্যুর হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। ১৯৭৩ সালের তেল সংকট দেখা যায়। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ বেধে যায় বিভিন্ন আরব দেশের।
ইতিহাসে এই যুদ্ধ আরব-ইসরায়েল চতুর্থ যুদ্ধ বা অক্টোবর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে আরো কয়েকটি দেশের সাথে নেদারল্যান্ডসও সমর্থন দেয় ইসরায়েলকে। ফলাফল অনুমিত। আরব দেশগুলো নেদারল্যান্ডসসহ সেসব দেশের প্রতি রুষ্ট হয়। যেহেতু তাদের হাতে সারাবিশ্বের তেলের বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিল, তাই তারা শাস্তিস্বরূপ ঐ দেশগুলোতে তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে নেদারল্যান্ডসে তেল সংকট দেখা দেয়।
এমন অবস্থায় নেদারল্যান্ডসের সামনে তখন তেল ছাড়া যেন সবকিছুই আছে। তাই তারা তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর সিদ্ধান্ত নিল। নির্দিষ্ট এক রবিবারে রাস্তায় সকল প্রকার গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকবে। তাই, ১৯৭৩ সালের ৪ নভেম্বর থেকে ১৯৭৪ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ‘কার ফ্রি সানডে’ পালন করে দেশটি। যেহেতু গাড়ি বন্ধ থাকবে,সেই বিকল্প হিসেবেই সাইকেল ফিরে আসতে শুরু করে।
১৯৭২ সালে শুরু হওয়া স্টপ দে কিন্ডারমুর্ড আন্দোলন আর ১৯৭৩ সালের তেল সংকট- দুইয়ে মিলে অবশেষে সাইকেল ফিরে আসে নেদারল্যান্ডসে। ধীরে ধীরে নির্মাণ করা হতে থাকে সাইকেলবান্ধব বিভিন্ন অবকাঠামো, রাস্তাগুলো হতে শুরু করে সাইকেলবান্ধব আর সাইকেলের বিক্রিও যায় বেড়ে। মানুষ আবার সাইকেলকে নিজেদের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বরণ করে নেয়। এভাবেই নেদারল্যান্ডস হয়ে উঠতে শুরু করে সাইকেলের দেশ।
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ফেসবুক ক্লিক করুন
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ইউটিউব ক্লিক করুন
[শিশুরাই তুলে ধরবে শিশুদের অধিকারের কথা, আপনিও লিখুন আপনার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]]
Comments are closed.