১৯০৭ সাল, আইনস্টাইন তখন সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরে অফিসের সামান্য কেরানি ছিলেন। একদিন তিনি ঔ অফিসের চেয়ারে বসে মহাকর্ষের রহস্য নিয়ে চিন্তা করছিলেন এবং হঠাৎ মনে পড়ে গেল লিফটের কথা। উপরে থাকা কোন লিফট যদি তার ছিড়ে নিচে পড়ে আসে তাহলে কি হবে? লিফটের ভেতরে থাকা সবাই ওজনহীন মনে করবেন! এই চিন্তাকেই আইনস্টাইন বলেছেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে সুখের চিন্তা।
প্রথমে আমরা আসি, লিফট ও ওজনহীনতা। ওজনহীনতা হচ্ছে ওজন অনুভব না করা। আর ওজন হচ্ছে, বস্তুর ভর ও অভিকর্ষ বলের গুনফল।
ধরা যাক, কেউ একজন স্থির লিফটে দাঁড়িয়ে আছে এবং লিফটা বারতলা ভবনের উপরে আছে। তখন ব্যক্তিটির ওজন অনুভূত হবে। কারণ, তখন লিফটটি বারতলা ভবনের উপরে ছিল আর স্থির। আমরা নিউটনের ৩য় সূত্র সবাই জানি। নিউটনের ৩য় সূত্রানুযায়ী, “প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে। “ এখন বারতলা ভবনের উপর স্থির লিফটে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটির ভর m এবং তার সাথে প্রয়োগকৃত অভিকর্ষ বল g। সুতরাং তখন ব্যক্তিটির ওজন হবে mg। এবং নিউটনের ৩য় সূত্রানুযায়ী ব্যক্তিটির ওজনের বিপরীতমুখী বলও হবে mg। তখন ব্যক্তিটিট একটা ওজন অনুভূত করবে। আমি আগেই বলেছিলাম, ওজন হচ্ছে বস্তুর ভর এবং অভিকর্ষ বলের গুনফল। তাহলে, ব্যক্তিটির ভর m এবং ভরের বিপরীতমুখী অভিকর্ষ বল g হলে, ব্যক্তিটি mg ওজন অনুভূত করছে। এখানে ব্যক্তিটি তার ভরের কারণে যে বল লিফটের উপর প্রয়োগ করছে শুধুমাত্র সেই বলটুকুই তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই অনুভূতটা কিন্তু লিফটটি স্থির থাকার ফলেই হয়েছে। যদি লিফটটি গতিশীল হত তখন কি একই ফল আসবে?
না, তখন আরও একটি বল চলে আসবে। কারণ, যদি লিফটটি গতিশীল হয় তাহলে লিফটের ত্বরণ বৃদ্ধি পাবে। লিফটটা যখন স্থির ছিল তখন তার ত্বরণ শূন্য এবং যখন গতিপ্রাপ্ত হলো তখন লিফটের সাথে একটি ত্বরণও যুক্ত হলো। ধরি, লিফটটি বারতলা থেকে উপরের দিকে যাচ্ছে বা লিফটটি স্থির অবস্থান থেকে উপরপর দিকে গতিশীল হচ্ছে। এখানে লিফটের ত্বরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ধরি সেটা a। এখন লিফট ব্যক্তিকে একটি বাড়তি বল ma প্রয়োগ করবে এবং এটি উপরের দিকে। সুতরাং লিফট ব্যক্তিটিকে মোট যে বল প্রয়োগ করবে F=mg+ma। এই বাড়তি বলটাকে ব্যক্তি বাড়তি ওজন মনে করবে। সুতরাং, এখানে একটি সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, লিফট গতিশীল হয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকলে আমরা লিফটে থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ওজন বেড়ে যাওয়া অনুভূত হবে। এখন যদি লিফটটি গতিশীল হয়ে নিচের দিকে নামে তাহলে কি হবে?
লিফটটি যদি নিচের দিকে নামে তবুও তার সাথে একটি ত্বরণ যুক্ত হবে। সেহেতু লিফটটি গতিশীল তাই এর সাথে ত্বরণও যুক্ত হবে। এবং এই ত্বরণটি a। এই ত্বরণের কারণে যে বলটা আসবে তা ব্যক্তিটির ওজনের বিপরীত দিকে। কারণ, ব্যক্তিটি যেহেতু নিচের দিকে নামছে সেহেতু ত্বরণটি হবে ব্যক্তিটির ওজনের বিপরীতমুখি। তাহলে ত্বরণটি হবে মন্দন বা ঋনাত্মক (-a)। বিপরীতমুখী বলটি হচ্ছে -ma এবং সেটা ব্যক্তি স্থির থাকাকালীন ভর ও অভিকর্ষ বলের কারণে যে বল mg তৈরি হলো তার থেকে কম হবে। F=mg+(-ma) => F=mg-ma
এখানে স্থির লিফটের তুলনায় একটু কম ওজন অনুভূত হবে। এবং কিছুটা ওজনহীন অনুভূত হবে। সুতরাং, আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, স্থির লিফট গতিশীল হয়ে নিচের দিকে নামলে লিফটে থাকা ব্যক্তি এবং ব্যক্তিদেীর ওজন কম অনুভূত হবে। আমরা দেখলাম, লিফটটি উপর দিকে গতিশীল হলে কি হয় এবং নিচের দিকে গতিশীল হলে কি হয়। এখন আসি আইনস্টাইনের চিন্তায়। তিনি বলেছেন লিফটের তার ছিড়ে নিজের দিকে পড়লে লিফটে থাকা ব্যক্তিরা কিছুটা ওজনহীন মনে করবেন।
এবার আসি আইনস্টাইনের কথায়, যদি লিফটটি তার ছিঁড়ে নিচে পড়ে আসে তখন কি ঘটবে? যখন লিফটটি তার ছিঁড়ে যাবে তখন এটি মুক্তভাবে মাটিতে পড়তে থাকবে এবং এর ত্বরণ হবে অভিকর্ষজ ত্বরণের সমান (9.8m/s^2)। ত্বরণের ফলে যে বলটা তৈরি হবে সেটা ব্যক্তিটির ওজনের সমান (mg) এবং বিপরীতে ক্রিয়া করবে। এখানে, a=g হবে। তাহলে, F=mg+m(-a)
F=mg+m(-g)
F=mg-mg
F=0
ব্যক্তির উপর লিফট যে বল প্রয়োগ করছে সেই মুকৃতভাবে পতনের কারণে তার সমান আরেকটা বল বিপরীত দিকে তৈরি হচ্ছে। দুইটি সমান বল যখন একই বস্তুর উপর সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ক্রিয়া করে তখন বল দুইটি লব্ধি বল শূন্য হয়ে যায়। ফলে সেখানে কার্যরত কোন বল থাকে না এবং সেখানে ওজনহীন অনুভূত হয়। সহজ কথায়, লিফট যখন মুক্তভাবে নিচে পড়ছে তখন লিফটের বেগ আর ব্যক্তির সমান। তাই ব্যক্তি আর লিফট একসাথে নিচে পড়বে ফলে পায়ের নিচে কোন ধরনের ধাক্কা বা বল অনুভব করবে না। লিফট এবং ব্যক্তি একই সময়ে মাটিতে এসে পড়বে। তাই মুক্তভাবে পড়ন্ত লিফটে নিজেকে ওজনহীন মনে হয়।
এবার আসি, ১৯০৭ সালে আইনস্টাইন ভাবতেন লিফটের তার ছিড়ে মুক্তভাবে পড়তে শুরু করলে মানুষ নিজেকে ওজনহীন মনে করবে। আইনস্টাইন ওজনহীনতা নিয়ে একটু উল্টোভাবে চিন্তা করেছিলেন।
মহাকর্ষ বল (পৃথিবীর ক্ষেত্রে অভিকর্ষ) সেখানে আছে সেখানে মহাকর্ষ বলের দিকে (ভূপৃষ্ঠের দিকে) যদি মুক্তভাবে বস্তুর ত্বরণ ঘটলে বস্তু ওজনহীন হয়। আবার মহাকর্ষ বলের বিপরীত দিকে ত্বরিত করলে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ হতে উপরের দিকে উঠলে বস্তুর ওজন বৃদ্ধি পায়। তাহলে মহাকর্ষ বল যেখানে নেই (মহাকাশে) এমন কোন স্থানে কোন বস্তুকে ত্বরণশীল কাঠামো দিয়ে (কোন বস্তুর মাধ্যমে ত্বরণ উৎপন্ন করে) টেনে নেওয়া হয় সেখানে কি বস্তু ওজন মনে করবে? আর তাই যদি হয় তাহলে তো সেখানে মহাকর্ষ বল উৎপন্ন হবে, এটা কি সম্ভব? আইন্সটাইন হিসাব করে দেখলেন তার অনুমান ঠিক। মহাকর্ষ বল যেখানে নেই সেখানে কোন বস্তুকে ত্বরান্বিত করলে মহাকর্ষ বল তৈরি করা সম্ভব! এই চিন্তায় ছিল আইনস্টাইনের সবচেয়ে সুখের চিন্তা। এই চিন্তাই মহাকর্ষের ভিতকে কাঁপিয়ে তুলেছিল।
নওশিন জাহান
দশম শ্রেণী, এডভোকেট খলিলুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়, জামালপুর।
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ফেসবুক ক্লিক করুন
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ইউটিউব ক্লিক করুন
[শিশুরাই তুলে ধরবে শিশুদের অধিকারের কথা, আপনিও লিখুন আপনার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]]
Comments are closed.