মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যশোর রোড

যশোরের তৎকালীন জমিদার কালীপোদ্দার ১৮৪০ সালে যশোর থেকে কালীঘাট পর্যন্ রাস্তা ও এর দু’ধারে বাংলায় কড়ই গাছগুলো রোপণ করেন। যাতে তীর্থস্নানে যাওয়ার পথে তার মা ও অন্যান্য পুণ্যার্থীরা গাছের ছায়ায় থেকেই যাত্রাস্থানে পৌঁছাতে পারেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের শরণার্থীরা এই রাস্তা ধরে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছিল। সেই সময়ে এই রাস্তাটিই ছিল তাদের শুধুমাত্র বেঁচে থাকার স্বপ্ন পূরণের পথ। তাদের মাঝে অনেকেই পথ চলার ক্লান্তি সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুবরণ করেন। এই রাস্তার প্রতিটি ধূলিকণাও সেই সময়ে হাজারো শরণার্থীদের ক্লান্তি, দুর্ভোগ ও বয়ে বেড়ানো স্বপ্নের সাক্ষী।

কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ যখন ভারতে এসেছিলেন, তখন যশোর রোডের শরণার্থীদের চোখের পানি নাড়া দিয়েছিল তাকেও। সেই কষ্ট দেখে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামের ১৫২ লাইনের হৃদয়স্পর্শী রচনা করেছিলেন তিনি।

পহেলা আগস্ট, ১৯৭১; নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন। সময় দুপুর দুইটা ত্রিশ থেকে রাত আটটা, কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। কনসার্ট উপলক্ষে রিহার্সালের সময়ও জর্জ হ্যারিসন ও বব ডিলান আসবেন কিনা নিশ্চিত ছিল না। এই কনসার্টেই বব ডিলান গান, অ্যালেন গিন্সবার্গের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এতে বিশ্ববাসীর সামনে যশোর রোডের ঘটনাপ্রবাহের অন্তরালে, বাংলাদেশে চলমান মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা মূর্তমান হয়ে ওঠে। সেই কনসার্টটিতে প্রায় ৪০ হাজার দর্শক হয়েছিল। সেখান থেকে প্রাপ্ত ২৫০ হাজার মার্কিন ডলার আয়োজকরা ইউনিসেফকে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য প্রদান করেন।

যশোর রোড ধরে মানচিত্রের সীমানা ঘেঁষেই বেনাপোল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সেখানে ৮ নং সেক্টরের সদর দপ্তর অবস্থিত ছিল। বর্তমানে বেনাপোলে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো স্থলবন্দরটি রয়েছে।

১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর এই সড়ক দিয়ে প্রথম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম শত্রুমুক্ত যশোর শহরে আসেন কলকাতা থেকে। তাঁরা যশোর টাউন হল মাঠে জনসভা করেন। এটিই বাংলাদেশ সরকারের প্রথম বিজয় সমাবেশ। এরপর এই পথে মুক্তিযোদ্ধা, মিত্র বাহিনী বাংলাদেশের বিজয় পতাকা উড়িয়ে ছুটে এসেছে। এরফলে যশোর রোডটি ঐতিহাসিক এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই রোডের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এত বড় অবদান রাখা যে যশোর রোড, তা কিন্তু আরো একবার আলোচনায় আসে গত ২০১৮ সালে। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ যশোর রোডের গাছগুলোকে কেটে দুই লেনের যশোর পেট্রাপোল পর্যন্ত রাস্তাটি চার লেনে উন্নীত করতে চাইছিলেন। আর তখনই দেশ জুড়ে সচেতন নাগরিক সমাজ আরো একবার রাস্তায় নেমে আসেন। দুইশত বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকা গাছগুলোকে তারা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন।

“ভয়েস অফ হ্যালো”র ফেসবুক ক্লিক করুন
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ইউটিউব ক্লিক করুন

[শিশুরাই তুলে ধরবে শিশুদের অধিকারের কথা, আপনিও লিখুন আপনার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]]

Comments are closed.