হারিয়ে যাচ্ছে জামালপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

জামালপুরে ১৯৭১’এর মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। এতে শহীদদের বীরত্বগাঁথা আত্মত্যাগের ইতিহাস বিলীন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। শহীদ পরিবারের সদস্যদের দাবী সরকারিভাবে যদি বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণ করা হয় তবে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে স্বাধীনতার ইতিহাস।

জামালপুর মহাশ্মশান, সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নয় মাসে এখানে দশ হাজারের বেশী মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। স্থানীয়ভাবে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও পুরো বধ্যভূমি ও গণকবরজুড়ে শহীদদের স্মরণে আর কিছুই চোখে পরবে না। জঙ্গলাকীর্ণ এই বধ্যভূমি পরে রয়েছে অবহেলায়।

আরেক কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একাত্তরের ‘টর্চার সেল’ নামে পরিচিত সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের তৎকালীন ডিগ্রী হোস্টেল। ১৯৭১ সালে এখানেই আল-বদর বাহীনি গড়ে তোলে তাদের ক্যাম্প। নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি রক্ষায় জরাজীর্ণ আর অরক্ষিত এই স্থাপনাটি সংরক্ষণে নেই কোন উদ্যোগ। নিরীহ সাধারণ নারী-পুরুষকে ধরে এনে এই ডিগ্রী হোস্টেলে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা বা পঙ্গু করে ফেলা হত। এরপর দড়ি বেঁধে টেনে হিচড়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে মাটি চাপা বা ফেলে দেয়া হত ডিগ্রী হোস্টেল থেকে কিছুটা অদূরে যা বর্তমানে ফৌতি কবরস্থান বধ্যভূমি নামে পরিচিত।

এই বধ্যভূমিতে জেলা পরিষদ একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করলেও নেই শহীদদের নামফলক বা তাদের বীরত্বের ইতিহাস তুলে ধরার কোন প্রয়াস। জেলার ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাইসহ বিভিন্ন নদ-নদীর তীরে বেশ কিছু জায়গায় রাজাকার, আল-বদর বাহিনী ও তাদের দোসরদের সহায়তায় সাধারণ মানুষকে ধরে এতে হত্যা করত পাক সেনারা। এরপর মৃতদেহগুলো কখনো নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হত, কখনও ফেলে রাখা হত নদীর পাড়েই। এছাড়াও সরিষাবাড়ী উপজেলার শহীদনগর-বারইপটল এলাকায় একদিনেই হত্যা করা হয় প্রায় অর্ধশত মানুষকে, আহত হন অনেকেই। নয় মাসের হত্যাকান্ডে সেখানে শহীদ হন প্রায় এক হাজার। এখানে শহীদদের স্মরণে রয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।

জেলার এমন অসংখ্য জায়গায় রয়েছে বদ্ধভূমি, যা সংরক্ষের অভাবে বিলীনপ্রায়। ঠিক কত জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার কোন দলিল পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে জামালপুরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পনের হাজারের বেশী মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হায়েনার দল ও রাজাকার, আল-বদর বাহীনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও শহীদদের আত্মত্যাগের বীরত্বগাঁথা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার দাবী জানান শহীদ পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়রা। সেইসাথে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদদের মর্যাদা প্রদান ও তাদের পরিবারকে সহায়তা করার দাবী সকলের।   

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই জামালপুরে গণহত্যা শুরু হয়। পুরো জেলায় পঞ্চাশটির বেশী বধ্যভূমি রয়েছে, তবে সরকারিভাবে সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি, কোথাও শহীদদের কোন তালিকা নেই। যদি গণহত্যার স্মৃতিকে সংরক্ষণ করা না হয় তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে জানান মুক্তিযুদ্ধের গবেষক উৎপল কান্তি ধর।

জামালপুর গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তা নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বধ্যভূমি সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় জামালপুর শ্মশানঘাট বধ্যভূমি উন্নয়ন ও সংরক্ষণের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে।

জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে শহরের ফৌতি কবরস্থান বধ্যভূমি, সরিষাবাড়ী উপজেলার বারইপটল-শহীদনগর ও বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুরে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো পর্যায়ক্রমে সংরক্ষন ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হবে।

যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পেয়েছি স্বাধীনতা, সেইসব শহীদদের তালিকা তৈরি, বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করতে নেই যথাযথ কোন উদ্যোগ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস জানাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে এমনই প্রত্যাশা সকলের।

আসমাউল আসিফ
এনটিভি, জামালপুর প্রতিনিধি।

“ভয়েস অফ হ্যালো”র ফেসবুক ক্লিক করুন
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ইউটিউব ক্লিক করুন

[শিশুরাই তুলে ধরবে শিশুদের অধিকারের কথা, আপনিও লিখুন আপনার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]]

Comments are closed.