যোগাযোগের সহজ মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ভূমিকা অনেক বেশি। আধুনিক এই সময়ে মানুষের হাতে আছে যোগাযোগ ও যাতায়াতের অসংখ্য মাধ্যম। মানুষ পৃথিবীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খুব স্বল্প সময়ে কোনরকম ভোগান্তি ছাড়াই ভ্রমণ করতে পারে। তবে ভ্রমণকারীদের অনেকেই জানে না তাদের পথচলা সহজ করতে কারা অবদান রেখে গেছেন। মুসলিম সভ্যতার শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা মানচিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে পৃথিবীর গতিপথ উল্টে দিয়েছিলেন।
মানচিত্রের চাহিদা সেই সভ্যতার শুরু থেকে ব্যবহার হয়ে আসছিল। হাজার বছর আগে যখন মানুষ ব্যবসা, গবেষণা ও ধর্মীয় কারণে বিশ্বভ্রমণ শুরু করেছিল, তখন থেকেই মানচিত্রের চাহিদা বাড়ছিল। মুসলিম বিজ্ঞানীরা বিশ্বের বেশ কিছু জনপ্রিয় মানচিত্র মুসলিম বিজ্ঞানী, ভূগোলবিদ ও সমুদ্র অভিযাত্রীরা অঙ্কন করেছিলেন। এখানে মুসলিম বিজ্ঞানীদের আঁকা ১০ টি জনপ্রিয় মানচিত্রের বিবরণ তুলে ধরা হলো।
মুসলিম বিজ্ঞানীদের আঁকা মধ্যযুগের ১০ মানচিত্র
১. আল-ইদরিসির বিশ্ব মানচিত্র : আধুনিক মরক্কোতে জন্মগ্রহণকারী মুহাম্মদ আল-ইদরিসি (১০৯৯-১১৬৬) আঁকেন মুসলিম সভ্যতার বিখ্যাত এই মানচিত্র। তিনি তাঁর মানচিত্রে দক্ষিণ দিককে ওপরে রাখেন। যেমনটি তখন সাধারণত করা হতো। আল-ইদরিসি কর্ডোভাতে লেখাপড়া করেন এবং সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের ‘দ্য নরম্যান কোর্ট অব পালার্মো’তে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৬ বছর বয়সে বিশ্বভ্রমণে বের হন এবং এশিয়া মাইনর, মরক্কো, স্পেন, দক্ষিণ ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন। পশ্চিম ইউরোপের ব্যাপারে তাঁর বেশির ভাগ বর্ণনা বাস্তব অভিজ্ঞার আলোকে দেওয়া। বলকান অঞ্চলের ব্যাপারেও এ কথা সত্য। তবে ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চল এবং উত্তর আফ্রিকা ছাড়া মুসলিম বিশ্বের অন্য অংশের ব্যাপারে তিনি অন্যদের ওপর নির্ভর করেছেন।
আল-ইদরিসি ছিলেন একজন সত্যিকার ভূগোলবিদ। তিনি ভূপৃষ্ঠের মানচিত্র অঙ্কনে নলাকার অভিক্ষেপ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। যদিও ১৫৬৯ সালে পদ্ধতি ফ্লেসার জেরার্ড মার্কেটরের বলে দাবি করা হয়। আল-ইদরিসির মানচিত্রে আফ্রিকার নিরক্ষীয় উচ্চভূমিতে অবস্থিত নীলনদের উৎসগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিল। আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরা যা উনিশ শতকে আবিষ্কার করেছে।
২. পিরি রেইসের মানচিত্র : পিরি রেইস খ্রিস্টীয় ১৬ শতকের একজন সুপরিচিত উসমানীয় নৌ সেনাপতি, ভূগোলবিদ ও মানচিত্রকর। তিনি তাঁর বিখ্যাত বিশ্ব মানচিত্র ১৫১৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করেন। ১৯২৯ সালে এটি ইস্তাম্বুলের টোপকাপি রাজপ্রাসাদে আবিষ্কৃত হয়। এটা সর্বপ্রাচীন তুর্কি মানচিত্র, যাতে নতুন বিশ্ব তথা আমেরিকা মহাদেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমেরিকার অস্তিত্ব আছে এমন প্রাচীন মানচিত্রগুলোর একটি। এই মানচিত্রের অর্ধেকজুড়ে ইউরোপের পশ্চিম উপকূল, উত্তর আফ্রিকা ও ব্রাজিলের উপকূলীয় অঞ্চল এবং অজোর ও ক্যানেরি দ্বীপগুলোসহ প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপ নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
৩. কিতাবুল গারায়িব : অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বোদলিয়ান পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে ‘কিতাবুল গারায়িব : আল-ফুনুন ওয়া মিলাহুল উয়ুন’ গ্রন্থটি। যা ইউরোপীয়রা যাকে ‘দ্য বুক অব কিউরিসিটিজ’ নামে চেনে। এটি মহাজাগতিক মানচিত্র বিষয়ক একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থ। বইটি সাধারণভাবে আধুনিক যুগ-পূর্ব মানচিত্র অঙ্কন এবং ইসলামী মানচিত্র অঙ্কনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ১০২০ থেকে ১০৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো একজন অজ্ঞাত পরিচয় লেখক এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি লেখেন। এতে জ্যোতির্বিদ্যা ও ভূগোল সম্পর্কে উচ্চতর বিশ্লেষণ আছে। এটি গুরুত্বপূর্ণ রঙিন মানচিত্র সিরিজের অংশ এবং এটি মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে মানুষের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেয়।
৪. মাহমুদ কাশগরির মানচিত্র : ১০৭৪ সালে মাহমুদ কাশগরি তাঁর ‘দিওয়ানু লুগাতিত-তুর্ক’ সম্পন্ন করেন। মাহমুদ কাশগরি ছিলেন একজন ভাষাবিদ। আরবি ভাষাভাষীদের তুর্কি ভাষা শেখাতে তিনি বইটি লেখেন। তিনি দাবি করেন, আরবির মতো তুর্কি ভাষাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মাহমুদ কাশগরি ইউরোপ থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত তুর্কি উপজাতিগুলোর আবাসস্থল চিহ্নিত করে একটি বৃত্তাকার মানচিত্র অঙ্কন করেন। তাঁর মানচিত্রে এশিয়ার পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের যে মানচিত্র আঁকেন তাতে বহু ভুল ছিল। তবে মানচিত্রের পূর্ব এশিয়ার অংশ নির্ভুল ছিল।
৫. বালখির মানচিত্র : আবু জায়েদ আহমদ বিন সাহল আল-বালখি (৮৫০-৯৩৪ খ্রি.) ছিলেন একজন ইরানি ভূগোলবিদ। তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী আল-কিন্দির শিষ্য ছিলেন। তিনি মানচিত্র অঙ্কন শেখাতে বাগদাদে একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলেন। বালখি নিজেও খোরাসানের একটি মানচিত্র অঙ্কন করেন।
৬. কাতিব সেলেবির মানচিত্র : তুরস্কের বিখ্যাত নৌ অভিযাত্রী কাতিব সেলেবি ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে ‘তুহফাতুল কাবির ফি আসফারিল বিহার’ গ্রন্থ রচনা করেন। বইটিকে সমুদ্র বিজ্ঞান ও নৌপথ গবেষণার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তুর্কি অবদান মনে করা হয়। কাতিব সেলেবি তাঁর বইয়ের ভূমিকায় ভূগোলবিদ্যা ও মানচিত্রের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তুরস্কের প্রতিটি অঞ্চলের শাসকদের উচিত তুর্কি সীমানা ও যুদ্ধক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে জানা। যদি তাদের পক্ষে পুরো পৃথিবী সম্পর্কে জানা সম্ভব না-ও হয়, তবে তুরস্ক ও এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো সম্পর্কে জানা। কাতিব সেলেবি তৎকালীন পৃথিবীর জলপথগুলো ও প্রধান বাণিজ্যিক পথ চিহ্নিত করে একটি মানচিত্র অঙ্কন করেন।
৭. ইবনে হাওকালের মানচিত্র : আবুল কাসেম মুহাম্মদ বিন হাওকাল তুরস্কের আল-জাজিরাতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পেশাগত জীবনে একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। ইবনে হাওকাল সারা পৃথিবীতে ভ্রমণ করেন এবং ৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে ‘সুরাতুল আরদ’ নামে বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। এ ছাড়া তিনি তাঁর ৩০ বছরের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে একটি বৃত্তাকার বৈশ্বিক মানচিত্রও অঙ্কন করেন। মানচিত্রে দক্ষিণ দিক ওপরে রাখা হয়।
৮. মুহাম্মদ সাউদির মানচিত্র : খ্রিস্টীয় ১৬ শতকে মুহাম্মদ বিন আমির সাউদি নিকসারি ‘তারিখে হিন্দে গারবি’ (পশ্চিম ভারতের ইতিহাস) রচনা করেন। এই বইয়ে ভৌগোলিক আবিষ্কার ও নতুন পৃথিবী (আমেরিকা) সম্পর্কে আলোচনা আছে। তিনি ইতালিয়ান ও স্প্যানিশ ভাষায় রচিত ভূগোল বিষয়ক গ্রন্থ থেকে তথ্য গ্রহণ করেছেন। বইটি ১৫৭৩ সালে সুলতান তৃতীয় মুরাদকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। মুহাম্মদ সাউদির বিশ্বমানচিত্রে উত্তর ও দক্ষিণ মানচিত্র এবং জাপান ও কোরীয় উপদ্বীপকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর মানচিত্রটির সঙ্গে আধুনিক মানচিত্রের দূরত্ব খুব বেশি নয়।
৯. আল-ইসতাখরির মানচিত্র : আবুল কাসেম উবায়দুল্লাহ বিন আবদুল্লাহ আল-ইসতাখরি (৯৩৪ খ্রি.) একটি বিশ্বমানচিত্র অঙ্কন করেন। তার মানচিত্রে দক্ষিণ দিকটি ওপরে রাখা হয়। এ ছাড়া তিনি ‘আল-মাসালিক ওয়াল মামালিক’ ও ‘সুওয়ারুল আকালিম’ গ্রন্থ রচনা করেন। বিশ্বাস করা হয় তিনি সর্বপ্রথম বায়ুকলের ধারণা দেন।
১০. আলী মাজেরের মানচিত্র : উসমানীয় নৌ-সেনাপতি আলী মাজের রাইস ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে একটি বিশ্বমানচিত্র অঙ্কন করেন। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্বমানচিত্র। তিনি তাঁর মানচিত্রের সঙ্গে সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় পোর্টালান চার্ট (Portolan Chart)-ও সংযুক্ত করেন। বর্তমানে মানচিত্রটি তুরস্কের তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘর গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।
এনজে/ভিঅফএইচ
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ফেসবুক ক্লিক করুন
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ইউটিউব ক্লিক করুন
[শিশুরাই তুলে ধরবে শিশুদের অধিকারের কথা, আপনিও লিখুন আপনার কথা। লেখার পাঠানোর ঠিকানা [email protected]]
Comments are closed.