তেজগাঁও রেলস্টেশনের পাশেই ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী মোবাশেরা আকতার। চতুর্থ শ্রেণির পাঠ শেষ করে আগামী শিক্ষাবর্ষে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হবে সে। মোবাশেরার মা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। মায়ের শারীরিক যে কোনো সমস্যা বা অসুস্থতায় কাজে যেতে হয় তাকেই। শিক্ষকরা তাকে স্কুলে যতটুকু পড়ান ততটুকুই। বস্তির মতো ঝুপড়ি ঘরে গিয়ে আর পড়াশোনা হয় না মোবাশেরার।
একই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া নয়নের পরিবারেরও ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। বাধ্য হয়ে রেলস্টেশনের পাশে কলার আড়তে দিনমজুরের কাজ করে সে। কোনো কোনো দিন কাজে না গিয়ে স্কুলে আসে নয়ন।
শুধু মোবাশেরা আর নয়নই নয় রাজধানীতে ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র এমনই। এসব বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পরিবার নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া।
সপ্তাহব্যাপী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে। পারিবারিক অভাব, অনটনের কারণে পড়ালেখা চালিয়ে নিতে না পেরে ঝরে পড়ছে অনেক শিশু।
এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বলছেন, আর্থিকভাবে একটু সচ্ছল অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠান না। এ মানসিকতা পরিহার করা দরকার। কারণ, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন সুন্দর অবকাঠামো করে দিয়েছে সরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীও বলছেন, সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।
ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আলেয়া ফেরদৌসী শিখা এ প্রতিবেদককে বলেন, রাজধানীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আসে অভাবী আর নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। এ নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
তেজগাঁও রেলস্টেশনের পাশের ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা কামরুননাহার, নাদিয়া সুলতানা ও মাসুমা আক্তার জানান, এই স্কুলের পাশেই বেশ কয়েকটি বস্তি রয়েছে। এ বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী এসব বস্তি থেকেই আসে। কারও পরিবার কারওয়ানবাজারের আড়তে বা তেজগাঁও কলার আড়তে কাজ করে। কেউ বা রিকশা চালায়। হতদরিদ্র আর নিম্নবিত্তদের সন্তানরাই এ স্কুলে পড়ছে। এই স্কুলের ছাত্র সোহাগ খান পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াশোনার পাশাপাশি শপিং মলে কাজ করে।
গত সপ্তাহে স্কুলটি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের সামনে ময়লার কারণে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। স্কুলের ফটকেই রিকশার গ্যারেজ করা হয়েছে। দিনরাত স্কুলের সামনে থাকে মাদকসেবীদের আনাগোনা। এ বিদ্যালয়ের অনেক শিশুও সল্যিউশনের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত বলে জানালেন শিক্ষকরা। নিয়মিত মনিটরিংয়ের ফলে তা বন্ধ হয়েছে।
করোনাকালীন সময়ে গত জানুয়ারিতে বিদ্যালয়টিতে প্রাক প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৩০২ জন শিশু শিক্ষার্থী থাকলেও বর্তমানে অন্তত ২০ শতাংশ ঝরে গেছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থীর পরিবার কর্ম হারিয়ে ঢাকা ছেড়েছে। তাই স্কুল ছাড়তে হয়েছে সেই শিক্ষার্থীকেও। পুরোদমে ক্লাস চালু না হওয়ায় এখনো ভর্তি হয়নি বেশিরভাগ শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাহী সভাপতি জাহিদুর রহমান বিশ্বাস বলেন, অনেক সচ্ছল অভিভাবক চান না, তার সন্তান নিম্নবিত্ত আর খেটে খাওয়াদের সন্তানের সঙ্গে বেড়ে উঠুক। ‘স্ট্যাটাস মেইনটেইন’ করতে গিয়েই অভিজাত পরিবারগুলো তাদের বাচ্চাকে এসব স্কুলে ভর্তি করছেন না। ক্রমে এ অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নানা সমস্যা সমাধান আর পড়াশোনার মানোন্নয়নে সরকারকে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান তিনি।
রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে রোটারি সরকারি প্রাথমিক বালক-বালিকা বিদ্যালয়। কাগজে-কলমে এই স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে ৫০৩ জন। সহকারী শিক্ষিকা শবনম শেফালি সাথী জানালেন, এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের ৯০ শতাংশের বেশি নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা। কোনো অভিভাবক রিকশাচালক কেউ বা অন্যের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। এখানে পড়ুয়া শিশু শিক্ষার্থীরা মেধাবী হলেও পড়াশোনার তেমন পরিবেশ পান না। স্কুলের বাইরে তাদের পড়ালেখার খবর নেওয়ার কেউ নেই। অভিভাবকরাও উদাসীন। উর্মি আকতার ক্লাস ওয়ানের শিক্ষার্থী ছিল এ স্কুলে। করোনায় তার পরিবার কাজ হারিয়ে গ্রামের বাড়ি নরসিংদী চলে গেছে। চলে গেছে উর্মিও। অভাব অনটন লেগেই আছে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আবদুস সামাদের পরিবারে।
করোনার কারণে দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার পর বিদ্যালয় খুললেও ক্লাস চলছে সপ্তাহে এক দিন। তাই সামাদ নরসিংদীতে একটি কারখানায় কাজ নিয়েছে। কবে স্কুলে ফিরবে- কেউ জানে না। মগবাজার মোড়ে বড় মগবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে গিয়েও পাওয়া যায় একই চিত্র।
প্রধান শিক্ষক সামসুন্নাহার বেগম জানান, প্রাক প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে ৫০৫ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকলেও করোনার মধ্যে ২৫ শতাংশের বেশি ঢাকা ছেড়েছে। শিক্ষার্থীরাও কেউ পরিবারের সঙ্গে গ্রামে চলে গেছে। কেউ বেছে নিয়েছে শিশুশ্রমের পথ। পরিবারে অভাব অনটন আর সচেতনতার অভাবে এই শিক্ষার্থীদের অনেকের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষ হচ্ছে না। স্কুলটিতে নেই খেলার মাঠ। মানসিক বিকাশ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে এই শিক্ষার্থীরা।
প্রধান শিক্ষিকা বলেন, সচ্ছল অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এসব বিদ্যালয়ে পাঠান না। অভিভাবকদের এই মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া উচিত।
বংশাল নিমতলীতে নবাবকাটরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, চতুর্থ শ্রেণিতে ১০৩ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকলেও মাত্র একজন ক্লাস করতে এসেছে। জানা গেল, সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শীতকালীন ছুটি কমিয়ে এনে এখনো বিদ্যালয় খোলা রেখেছে। কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত ছুটি মেনে অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে আসছে না। এ বিদ্যালয়েও ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবার অভাব-অনটনের মধ্যে দিনাতিপাত করে। তাদের অভিভাবকরাও অসচেতন। চানখাঁরপুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে কথা হয় সহকারী শিক্ষিকা মিতালি বণিকের সঙ্গে।
তিনি জানান, এ বিদ্যালয়ে মধ্যবিত্তের কোনো সন্তানও পড়াশোনা করে না। অভিভাবকের মধ্যে কেউ পুরান ঢাকায় কারখানায় কাজ করেন কেউ বা অন্যভাবে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেকের অভিভাবক গৃহকর্মীর কাজ করছেন। অভাব অনটনের মধ্যেও এই শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসছে। এদের মধ্যে করোনার কারণে কিছু ঝরে পড়েছে। পুরোদমে ক্লাস শুরু হলে এর সংখ্যা নিরূপণ করা যাবে বলে জানান তিনি।
তুলনামূলক পরিপাটি পরিবেশ লক্ষ্য করা গেল তেজগাঁও ফার্ম সরকারি বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিক থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৪১৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু এ বিদ্যালয়েও সিংহভাগ শিক্ষার্থী আসে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। কিছুটা সচ্ছল পরিবারের অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানকে এ বিদ্যালয়ে পাঠালেও সেটি অন্য স্কুলে ভর্তিতে কোটা পাওয়ার আশায়। সহকারী শিক্ষিকা ইয়াসমিন আরা জানালেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হলে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিতে কোটা পাওয়া যায়। তাই অনেক সচেতন অভিভাবকও তাদের বাচ্চাকে এসব স্কুলে পাঠান।
তিনি আরও জানান, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আর পড়াশোনার আগ্রহ বাড়াতে সরকার উপবৃত্তি ও বিস্কুট বিতরণ করে থাকে। তবে উপবৃত্তির হার খুব কম আর পাওয়ার প্রক্রিয়াও সহজ নয়। এ বিষয়ে সরকারকে নজর দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সচ্ছল পরিবারের সদস্যদের অনাগ্রহের ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো করে দিয়েছে সরকার। বিনামূল্যে পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি ও বিস্কুট দেওয়া হচ্ছে। এখন অনেক মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে এসব স্কুলে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে আর অন্যভাবে দেখার সুযোগ নেই। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হোক আর মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের সন্তান- সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।
আকতারুজ্জামান
নিজস্ব প্রতিবেদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ফেসবুক ক্লিক করুন
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ইউটিউব ক্লিক করুন
[শিশুরাই তুলে ধরবে শিশুদের অধিকারের কথা, আপনিও লিখুন আপনার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]]
Comments are closed.