আমাদের দেশে অনলাইনে শিশুদের উপস্থিতি যতটা সহজ পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোত ততটা নয়, যতটা ব্যবহার করা হয়—তা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরের মধ্যে এবং তা তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তিতে যোগ্য করে গড়ে তুলতে। কিন্তু আমরা এর বিপরীত। ফলে শিশুরা কার্টুন ও গেমে আসক্তি, এমনকি ফেসবুক-ইউটিউব ব্যবহার করারও সুযোগ পায়।
অধিকাংশ কার্টুন নগ্ন-অর্ধনগ্নভাবে তৈরি করা, কার্টুনের একজন যুবতীর মুখের বয়স আট আর বুকের বয়স দেখা যায় আঠারো। যা কোমলপ্রাণে নেতিবাচক প্রশ্নের জন্ম হওয়াটা স্বাভাবিক। অপরদিকে ইউটিউবে অটো-প্লে অপশন চালু থাকায় নির্ধারিত একটি ভিডিও দেখার পর অন্য বিষয়ের ভিডিও চলে আসে। একজন শিশু হয়তো কার্টুন দেখছে, এসময় মোবাইলের স্ক্রিনের অন্যপাশে টাচ লেগে অশ্লীল হিন্দি গান চলে আসলো। এসময় শিশুমনে নেতিবাচক প্রশ্ন ও অভিভাবকদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। তাই ইউটিউবকে আরো যুগোপযোগী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ করতে হবে। এছাড়া ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্ধারিত একটা বয়সের বাধ্যবাধকতা রাখা জরুরি। এসবের একাউন্ট খুলতে এনআইডি কার্ড বা আঠারো-বিশ বছর প্রমাণ করার উপযুক্ত কোনো কাগজ সাবমিট বাধ্যতামূলক করা হোক।
শিশুরা অনলাইন গেম ও কার্টুনের দিকেই বেশি ঝুঁকে থাকে। একেবার ছোট শিশুরা কার্টুনের প্রতি আগ্রহী আর কিশোর বয়সীরা মোবাইলে ইন্টারনেট-ডাটা ব্যবহার করে গেম খেলতে ভালোবাসে। বর্তমানে দেশে ‘ফ্রি-ফায়ার’ ও ‘পাবজি’ নামে দু’টি অনলাইন গেম ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। একসময় মোবাইলে তরুণ বয়সী ও নিঃসঙ্গ ব্যক্তিরা দাবা বা লুডু জাতীয় কিছু খেলতেন শখের বসে। এসব খেলা জনপ্রিয় হওয়ায় এবং করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের অনলাইন গেমের দিকে সুকৌশলে ধাবিত করছে সংঘবদ্ধ অনলাইনভিত্তিক কর্পোরেট চক্র। ভবিষ্যত প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। আমার প্রশ্ন—সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কি অন্ধ? নাকি দেখেও তারা চুপ করে আছে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো হইচই না হলে যে এ দেশে সহজে কোনোকিছুর প্রতিকার মেলে না—এটা অনেকটাই নিয়ম পরিণত হয়েছে।
বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগে অনলাইনভিত্তিক জীবনাচার আমাদের চলার পথকে সহজ করেছে। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষ অনলাইন নির্ভরতা ও তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার আমাদের জন্য হুমকিস্বরপ। বিশেষ করে বাংলাদেশে শিশুদের জন্য অনলাইন ব্যবহার পুরোপুরি নিরাপদ তো নয়ই; উপরন্তু মারাত্মক ক্ষতির কারণ। মোবাইল, লেপটপ-ডেক্সটপ সহজলভ্য ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ওয়াই-ফাই নেটওয়ার পৌঁছ যাওয়ায় যে কেউ চাইলেই অনলাইন ব্যবহার করতে পারেন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনমান উনয়নের জন্য সরকার অনলাইনের নির্ভরতা বাড়ালেও অনলাইনের নিরাপদ ব্যবহার ও শিশুদের জন্য নিরাপদ অনলাইন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। আর এই অবাধ ও অপব্যবহার সহসাই নিয়ন্ত্রণে করত না পারলে জাতিকে চরম বিপর্যয়ে পড়তে হবে নিশ্চিত।
২০১৭ সাল দক্ষিণ কোরিয়ার একটি গেম ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান ‘ব্লু হোয়েল’ নামে অনলাইন ভিডিও গেম আবিস্কার করে। এটি সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও রীতিমতো হইচই ফেলে দেয়। এ গেমের আসক্তি অগণিত কিশারের মস্তিস্ক বিকৃতি, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনে। অনেকটা ‘ব্লু হোয়েল’-এর মতোই রোমাঞ্চকর আসক্তি গেম ‘ফ্রি ফায়ার’ চীনের একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৯ সালে তৈরি করে। ২০১৯ সালে থেকে এখন পর্যন্ত এটি বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক ডাউনলোডকৃত মোবাইল গেম বলে জানা গেছে। গেমটি অন্য খেলোয়াড়কে হত্যা করার জন্য অস্ত্র এবং সরঞ্জামের সন্ধানে একটি দ্বীপে প্যারাসুট থেকে নেমে ৫০ জন ও তার অধিক খেলোয়াড়কে অন্তর্ভুক্ত করে। বর্তমানে ‘ফ্রি ফায়ার’কে আরো উন্নত সংস্করণে ‘ফ্রি ফায়ার ম্যাক্স’ নামে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এটি আমাদের কাছে দুঃসংবাদ।
২০১৯ সাল নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দু’টি মসজিদে হামলা চালিয়েছিল দক্ষিণপন্থী এক সন্ত্রাসী। বন্দুক নিয়ে মসজিদ ঢুকে বুশ-ফায়ার করে ৫১ জন সাধারণ মুসলিমকে হত্যা করা হয়। গোটা ঘটনা ক্যামেরায় রেকর্ড ও হত্যার দৃশ্য ফেসবুক লাইভে প্রচার করে হামলাকারী সন্ত্রাসী। ওই হামলার আদলে তৈরি বর্তমান বিশ্বব্যাপী অন্যতম জনপ্রিয় অনলাইন গেম ‘পাবজি’। এ ধরনের গেম দেশে শিশুদের কাছে জনপ্রিয়তা পাওয়ার ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে যাচ্ছে। ভার্চুয়ালি অর্থ লেনদেন হচ্ছে এমএমএস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
অনলাইনে গেমদু’টি ফেসবুক লাইভে শেয়ার করে অন্যদের ইনভাইট করা হয় আকর্ষণীয়ভাবে। ফেসবুক পোস্ট বা লাইভে ইনভাইটকৃত গেমগুলোর ভিডিও-কভারে নারী-পুরুষের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও নগ্ন-অর্ধনগ্ন যুবতী দিয়ে সাজানো থাকে। এসব অনলাইন গেম কোমলমতি শিশু-কিশোর তথা ভবিষ্যত প্রজন্মের ওপর মনস্তাত্বিক প্রভাব ফেলছে। নিঃসঙ্গতা বা সময় কাটানোর মাধ্যম পরিণত হচ্ছে নেশাতে। যা মাদকদ্রব্য গ্রহণের চাইতেও ভয়াবহ। ঝাুঁকের বশে তরুণদের আগ্রাসী করে তুলছে এগুলো। ইন্টারনেট-ডাটার খরচ যোগাত অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। গত ২১ মে চাঁদপুর মামুন (১৪) নামে এক কিশোর মোবাইলের ডাটা কেনার টাকা না পেয়ে মায়ের সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করে, যা গণমাধ্যমে এসেছে। এমন চলতে থাকল আমাদের জন্য অশনিসংকেত।
করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ একবছরের অধিক সময় ধরে। এতে একদিকে শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে গেম দু’টিতে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি বেড়ে যাওয়ায় তরুণ প্রজন্মর মস্তিস্কের বিকৃতি, কোমল মনে চিন্তাভাবনায় কুপ্রভাব, খাবার গ্রহণে গড়িমসি, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, মাথাব্যথাসহ নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। সুযোগ পেলেই মোবাইল নিয়ে নিরিবিলি স্থানে বসে খেলা, কখনো বা দলবদ্ধভাবে গোপনস্থানগুলোত বসে খেলতে গিয়ে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ঝগড়া, রাস্তায় হেটে হেটে খেলতে গিয়ে দুর্ঘটনা, রাত জেগে দীর্ঘসময় খেলে স্বাস্থ্যহানী হওয়া আমাদের সন্তানদের জন্য গভীর চিন্তার বিষয়। কেননা এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র।
যেভাবে বিদেশি অনলাইন-কর্পোরট প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশে সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনলাইন অ্যাপস সহজলভ্য করে পাঠায়—তা সহসাই বন্ধ করতে হবে। প্রজন্মকে ধংস করে—এমন সকল অনলাইন গেম খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হোক। সম্প্রতি নেপালে পাবজি নিষিদ্ধ করছে সে দেশের আদালত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের গুজরাটেও এ গেমটি নিষিদ্ধ ও কয়েকজনকে গ্রপ্তার করা হয়। বাংলাদশেও পাবজি সাময়িকভাব বন্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু কী কারণে ও কার স্বার্থে ফর চালু হয়েছে তা জানে না দেশের মানুষ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘পাবজি’ ও ‘ফ্রি-ফায়ার’ গেম নিষিদ্ধের জন্য বিটিআরসিকে সুপারিশ করেছে, অথচ তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। শিশুদের বাঁচানোর স্বার্থে এই একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে কতদিন লাগতে পারে যে, এত গড়িমসি!
সর্বোপরি সরকারকে বলবো, অনলাইনের অপব্যবহার তথা আসক্তি থেকে বাঁচাতে তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষা ও সুস্থ্য সংস্কৃতিতে ফেরান। সীমিত আকারে হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিন। দেশের জেলা-উপজেলায় যেসকল শিল্পকলা একাডেমি রয়েছে, যেগুলাতে প্রতিবছর সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়; সেগুলোকে যুগোপযোগী ও গতিশীল করুন, সেখান সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়ান। যেসকল ক্রীড়া সংগঠন রয়েছে, সেসব সক্রিয় করুন। দেশের সকল খেলার মাঠগুলো পরিচর্যা ও বেদখলকৃত মাঠ উদ্ধার করে গ্রামীণ খেলাধুলার পরিবেশ ফিরিয়ে আনুন। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনের আন্তরিকতা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পারিবারিক সচেতনতাই পারে জাতিকে অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাতে।
লেখক : জাকারিয়া জাহাঙ্গীর
কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ফেসবুক ক্লিক করুন
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ইউটিউব ক্লিক করুন
[শিশুরাই তুলে ধরবে শিশুদের অধিকারের কথা, আপনিও লিখুন আপনার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]]
Comments are closed.