“ফানুস ওড়ানো নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি”

‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ এবং ‘ইংরেজি নববর্ষ’ জাঁকজমকভাবে পালন করা বাঙালির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতের চেয়ে বিগত বছরগুলোতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এবং জেলা-উপজেলা শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামেও এ সংস্কৃতি বিস্তৃতি লাভ করেছে।

এই নববর্ষ পালনের মূল অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে গান-বাজনা, বিভিন্ন ধরনের পার্টি, পটকা বা আতশবাজি পোড়ানো ও আকাশে ফানুস ওড়ানো। এ ছাড়াও যেকোনো অনুষ্ঠানের জনপ্রিয় অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে খোলা মাঠ বা বাসাবাড়ির ছাদ থেকে ফানুস ওড়ানো।

মূল কথা হচ্ছে- থার্টিফার্স্ট নাইট ও ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনে শব্দদূষণের কথা বাদ দিলেও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে ফানুস ওড়ানো। এ বছর সে ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম হলেও বড় ধরনের আশঙ্কা থেকে কিন্তু একেবারে মুক্তি মেলেনি এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কেননা ভবিষ্যতে ফানুসের কারণে আগুন লেগে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। এমনকি একটি শহরও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, এ বছর ফানুস ওড়াতে গিয়ে রাজধানীর অন্তত বারোটি স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মাতুয়াইল স্কুল রোডের একটি বাড়িতে ফানুস থেকে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়া গেছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিটকে কাজ করতে হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর তেজগাঁও, যাত্রাবাড়ী, ধানমন্ডি, রায়েরবাগ, কলাবাগান, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, ডেমরা, সূত্রাপুর, লালবাগসহ বেশ কয়েকটি বাসার ছাদ ও সড়কের তারে ফানুস থেকে আগুন লাগার খবর পাওয়া গেছে। রাত আড়াইটা নাগাদ এসব স্থানে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর খবর হচ্ছেÑ উদযাপন শুরুর কিছু সময়ের মধ্যে ঘটে যায় অনেকগুলো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। একসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর হটলাইন নম্বরগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে সারা দেশ থেকে প্রায় ২০০টি অগ্নিকাণ্ডের খবর আসে ফায়ার সার্ভিস ও ৯৯৯-এর কন্ট্রোল রুমে। ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারে, এসব অগ্নিকাণ্ডের বেশিরভাগই ঘটেছে ফানুসের কারণে। তবে কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড আতশবাজির কারণে হয়েছে বলে জানা গেছে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, শৈত্যপ্রবাহ কিংবা বাতাস নয়।

ঢাকা শহরের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ফানুস ওড়ানোর কারণে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হতে পারে। ৩১ ডিসেম্বরের ওড়ানো ফানুসগুলো যদি রাজধানীর কোনো বস্তি এলাকায় পড়ত, তাহলে আরও ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনার সাক্ষী হতো দেশ। তাই নববর্ষ উদযাপনে ফানুস ওড়ানো বন্ধ চায় ফায়ার সার্ভিস।

আমরা জানি, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে পটকা বা আতশবাজি ফোটানোর যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, তা অমান্য করেই ঢাকায় থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন করেছেন অনেকে। ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি ডিএমপি কমিশনার (সাবেক) মো. আছাদুজ্জামান মিয়ার সই করা এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রাজধানীতে ফানুস ওড়ানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ফানুসে থাকা কেরোসিন বাতি না নিভেই মহানগরীর বিভিন্ন জায়গায় পড়ছে। এতে আগুন লাগাসহ বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তাজনিত হুমকি তৈরি হচ্ছে। ফানুস ওড়ানো অব্যাহত রাখলে যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। সে কারণে ফানুস ওড়ানো থেকে সবাইকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছিল ডিএমপি। এ নিষেধাজ্ঞা না মানলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছিল ডিএমপি।

বলতে গেলে, আজকের এই ফানুস ওড়ানোর সংস্কৃতি খোলা জায়গা ও পাহাড়ি এলাকার। সেখানে এগুলো ওড়ানো যায়। কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার জন্য ফানুস ওড়ানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ফানুস ওড়ানোর পাশাপাশি বিক্রি করতেও নিষেধ করা হয়েছিল। বিক্রেতারা ডিএমপির অনুরোধে সাড়া না দিলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা?

তাই তো আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস ওড়ানো বন্ধ করতে না পারায় সাংবাদিকদের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। কেননা ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা বাজতেই রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় ফানুস ওড়ানো শুরু হয়। একযোগে ফোটানো হয় পটকা বা আতশবাজি। আর তাতে বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে মহানগরী। ফানুসের আগুন ছিটকে পড়ে বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে। যদিও তাতে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

আমরা দেখেছি, ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর থেকেই রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় আতশবাজি ফোটানো শুরু হয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আতশবাজির বিকট শব্দও বাড়তে থাকে। আসলে আতশবাজি থামানোর বিষয় নয়। তা হাত দিয়ে আটকেও রাখা যায় না। শুধু মানুষকে অনুরোধ করা যায়। মূলত এসব আতশবাজি ফোটায় কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণীরা। পরিবারের ছোটরা আতশবাজি কিনে ফোটাচ্ছে এবং ফানুস কিনে ওড়াচ্ছে। এটা বিধিনিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। পুলিশ-প্রশাসন তো ঘরে ঘরে গিয়ে নিষেধ করতে পারবে না।

তাই নগরবাসীকে অন্তত বয়স্ক বা অসুস্থ মানুষের কথা বিবেচনা করে এসবকে সীমিত রাখতে হবে বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। স্থাপনা বা বিদ্যুতের তারের কথা চিন্তা করে ফানুস ওড়ানো সীমিত বা বন্ধ করতে হবে। যদি সম্ভব হয়, খোলা জায়গায় বা জলাশয়ের পাশে ফানুস ওড়ানো যেতে পারে। তা না হলে মানুষ বাড়িতেই তার পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দ উদযাপন করবে। গত ৩১ ডিসেম্বর রাতে বাসার ছাদে বা বেলকনিতে অনেক আতঙ্কিত মানুষের উপস্থিতিও লক্ষ করা গেছে। কোথাও কোথাও দুই ভবনের মাঝখানে আগুনসহ ফানুস পড়ে আটকে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে আনন্দ উপভোগের চেয়ে আতঙ্কের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।

আমাদের মনে হওয়া স্বাভাবিক, প্রত্যেক মহল্লায় আবাসন এলাকার একটি কমিটি থাকে। ফানুস নিয়ন্ত্রণে তারা উদ্যোগ নিতে পারে। এলাকার বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে প্রত্যেক ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে। পাশাপাশি প্রত্যেক বাড়িওয়ালা তার ভাড়াটিয়াদের ফানুস ওড়ানোর ব্যাপারে সতর্ক করবেন অথবা নিরুৎসাহিত করবেন। কেননা ঢাকা শহরে ভবনের পাশে ভবন দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কারণে একটি ফানুসে আগুন লেগে নিচে পড়ে গেলে তা থেকে আগুন ছড়ানো বেশি সময়ের ব্যাপার নয়। কিংবা ফানুস এমন জায়গায় পড়তে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করতে ফায়ার সার্ভিসের শরণাপন্ন হতে হবে। ততক্ষণে হয়তো এক ভবন থেকে বহু ভবনে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

উৎসব-পার্বণ আসে আমাদের আনন্দ দিতে। সেই উৎসব পালন করতে গিয়ে যদি ঘরে ঘরে কান্না আসে; তাহলে তা হবে সবচেয়ে বেশি হৃদয়বিদারক। তাই শুধু ভবন মালিক সমিতি বা এলাকার সোসাইটির ওপর দায়িত্ব না চাপিয়ে আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সতর্ক হতে পারি। প্রয়োজনে নিজেরাই ফানুস ওড়ানো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যদিও আকাশে ফানুস ওড়ানো বৌদ্ধদের ধর্মীয় একটি রীতি। তারা একটি নির্দিষ্ট সময় ফানুস উড়িয়ে থাকেন। সে সময় পুলিশের কাছ থেকে অনুমতিও নেওয়া হয়। ফলে থার্টিফার্স্ট নাইটে ফানুস ওড়ানোর নিষেধাজ্ঞা তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাই আসুন প্রত্যেকেই ফানুসের আগুনের ব্যাপারে সচেতন হই। বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে নিজেদের রক্ষা করি।

মনে রাখবেন, আপনার শহর বাঁচলে আপনিও বাঁচবেন। আপনার শহর পুড়লে আপনিও পুড়বেন। কেননা কথায় আছে, ‘নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও এড়ায় না।’ তারপরও যদি দেশের নাগরিকরা সচেতন না হয়, তাহলে ডিএমপির নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে কঠোরভাবে। একটু কঠোরতা যদি অসংখ্য মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে তাহলে মন্দ কী? বিষয়টি ভেবে দেখার সময় হয়েছে। সবাইকেই ভাবতে হবে। ভাবা উচিত বলে মনে করি। নতুন বছর যেন আনন্দ বয়ে আনে, শঙ্কা নয়। সূত্র: সময়ের আলো

লেখক: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কথাশিল্পী ও সাংবাদিক, জাগোনিউজ২৪.কম।

“ভয়েস অফ হ্যালো”র ফেসবুক ক্লিক করুন
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ইউটিউব ক্লিক করুন

[শিশুরাই তুলে ধরবে শিশুদের অধিকারের কথা, আপনিও লিখুন আপনার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]] 

Comments are closed.