আমি চিন্তিত মুখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই কি কফি টা খাবি, না খেলে চলে যা, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আর মনে রাখিস, “বাবা হওয়া ততটাও সহজ না”। ছেলের বয়স যখন ৬ বছ তখন সে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় পাড়ি জমায়। যাওয়ার কদিন পরেই ছেলের স্কুলের ফলাফল প্রকাশিত হয়।
যেখানে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ছেলে। যার ফলে বাবা বিদেশে থেকে শুনে খুশিতে সহকর্মীদের মিষ্টি খাওয়ায়। এছাড়া ছেলের যেন কষ্ট না হয় বাড়তি পরিশ্রম শুরু করে। ছেলে যেন ছেলের দাদুর ব্রেন পেয়েছে। এভাবে দেখতে দেখতে ৭ বছর কেটে যায়। ছেলে প্রতিদিন ভিডিও কলে বাবার সাথে নানান ধরনের গল্প করে। তবে কখনোই কোন কষ্টের কথা বলে না কারণ মায়ের নিষেধ। বাবা চিন্তা করবে, তার কষ্ট হবে। ছেলে এবার পাড়ার হাই স্কুল ক্লাবের ক্রিকেট টিমের অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছে। যার ফলে বাবা আরও বেশ খুশি হয়েছে।
এবার ছেলে অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছে। এপর্যন্ত কোন ক্লাসে রোল এক থেকে পিছিয়ে দুই হয়নি। এবার আর বাবার ভালো লাগে না। দেশে চলে আসবে। শুনে ছেলের আর ঘুম হয় না। বাবা আসবে এই জন্য তার কত্তো আয়োজন। অবশেষে বাবা আসে। এসে তাদের বাপ ছেলের পাগলামি দেখে মা মুখ লুকিয়ে হাসে আর কত্তো পিঠার আয়োজন। সারাদিন বাড়িতে মেহমানের ভিড় লেগেই রয়েছে।
এইদিকে, বাপ ছেলের সেদিকে খেয়াল নেই। জীবনে প্রথমবার ছেলের স্কুলের উপস্থিতির খাতায় লালদাগ পড়েছে। তাও আবার একটানা সাত দিন। সাত দিন পড়ে প্রধানশিক্ষকসহ সকল শিক্ষক ছেলের খবর নিতে চলে আসে। সবাইকে পিঠা সহ পর্যাপ্ত আপ্যায়ন করেন মা। ছেলের বাবার আদেশ, আমার ছেলের স্যার দের আপ্যায়নের যেন কোন ঘাটতি না হয়।
পরদিন থেকে ছেলে আবারও স্কুলে নিয়মিত হয়। তবে সাতদিনের পড়ার ঘাটতি দেখে ছেলের মাথায় হাত। ছেলে বাড়িতে এসে আবারও সব ভুলে পড়াশোনা শুরু করে। বাবা তাকে অভয় দেন, চিন্তা করো না শুনো, তুমি আবারও স্কুলে প্রথম হবে। ছেলের পড়াশোনায় মনোযোগ দেখে ছেলের বাবা তো খুশিতে আত্মহারা।
সাত দিনের পড়াশোনার ঘাটতি, স্কুলে খুব চাপ যাচ্ছে। যার ফলে বার বার ছেলের ক্লাসে পড়া মিস হচ্ছে। তাই প্রধান শিক্ষক রেগে ছেলে কে থাপ্পড় দেয়।এতে ছেলের গালে দাগ হয়। বাবা তো ছেলের গালে দাগ দেখে রাগে আগুন হয়েছে। স্কুলে যাবে, মাস্টার কে দেখে ছাড়বে, মাস্টার কি দেশের আইন জানে না! ইত্যাদি বলে চিল্লাতে চিল্লাতে স্কুলের দিকে এগিয়ে যায়।
এই বাবা এমন কাজ দেখে মা তো হাতে পায়ে ধরে ফেরাতে যায়। লাথি দিয়ে মা কে সিঁড়ি থেকে ফেলে দিয়ে আসে স্কুলে। এসে হেড স্যার কে ইচ্ছে মতো অপমান করে। এরপরে আমার ছেলের গায়ে হাত ওঠালে দেখে নিবো বলে ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে আসে।
এসে দেখে ছেলের মাকে তার দাদু হাসপাতালে নিয়ে গেছে। হাসপাতালে গিয়ে দেখে তার মাথায় ৪টা সেলাই লেগেছে। যাই হোক তার ছেলের প্রতি কোন আঘাত মানবে না সে। সেদিন খেলা দেখতে গিয়ে দেখে ক্লাবের এক বড়ভাই ছেলে কে থাপ্পড় দেয়। এটা দেখে ছেলের খেলতে যাওয়া বন্ধ করে দেয় যার ফলে ছেলেও অধিনায়কত্ব হারায়।
ইতোমধ্যে ছেলের জেএসসি পরীক্ষা ফলাফল প্রকাশি হয়েছে। যেখানে পরীক্ষায় ছেলে এক বিষয়ে ফেল করে। রাগে আগুন হয়ে বাবা এবার ছেলে কে অনেক মারে। চিল্লাতে থাকে এই ছেলের জন্য এতো কষ্ট করি, এইদিন দেখার জন্য বাড়িতে পড়ে আছি! ইত্যাদি বলে সে পরের সপ্তাহের টিকিট করে আমেরিকা চলে যাওয়ার।
এতে করে দুদিন সে ভাত খায় না। দুদিন পরে বাবার রাগ কমলে ছেলের মা আস্তে আস্তে বলেন, তুমি যদি ধৈর্য্য ধরে শোন তবে আমি কিছু কথা বলবো। আমার ধৈর্য্য নেই, বলে উঠে যায়। এরমধ্যে আর খাওয়া হয়নি তার। আমেরিকা গিয়ে বন্ধুদের কি বলবে সে। মুখ দেখাবে কিভাবে। এসব ভাবতে ভাবতে শরীর ভেঙে উঠে। ছেলেও এই কয়দিনে একফোঁটা পানি মুখে দেয়নি। ছেলের এমন অবস্থা দেখে বাবা আরও চিন্তায় পড়ে যায়।
ছেলের মায়ের কাছে এসে বসে বলে কি যেন বলতে চেয়েছিলে তুমি? তখন মায়ের মুখ খুলে আমি কথা বলার মাঝে কিছু বলতে পারবে না, উঠে যেতে পারবে না, মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনতে হবে। আচ্ছা বল।
মা: এতদিন ছেলের দেখাশোনা কে করেছে?
বাবা: তুমি।
মা: কোনদিন কি দেখেছো, ছেলের স্যার কিভাবে মেরেছে ছেলে কে? ছেলের পিঠে এখনো দাগ আছে। ছেলে কোনদিনই স্কুল মিস করেনি, তোমার অতিরিক্ত আদরে ছেলে নিয়মিত স্কুল মিস করা শুরু করেছে। বলছি না আদর করা ভুল বা অন্যায়। তবে অতিরিক্ত সবকিছুই খারাপ। ছেলে ক্লাসে সবসময় প্রথম হওয়া সত্বেও প্রতি মুহুর্তে সে স্যারদের ভয় পেতো। তোমার আসকারায় সে স্যারদের সম্মান করা ভুলতে বসেছে।
আজ তুমি ছেলেকে যেভাবে মেরেছ এতে ছেলের তোমার প্রতি সম্মান কমেছে। এটা আমি চাইনি। যে স্যার আমার ছেলেকে নিজের ছেলের চেয়ে বেশি আদর করেন সেই স্যার আজ তোমার খারাপ ব্যবহারের জন্য ছেলেকে মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন।
যেই ছেলে পড়ার সময় ভাতও খায় না। নামাজের সময় আমাকে নামাজের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই ছেলে আজ নামাজ পড়ার কথা ভুলেই গেছে। পড়ার সময় তোমার সাথে দাবা খেলে।
ক্লাবের যে বড়ভাই ওকে নিজে হাতে খেলা শিখিয়েছে সেই বড়ভাইয়ের অধিকার আছে ওর গায়ে হাত তোলার। সন্তান মানুষ করার জন্য আদরের বিকল্প নেই তবে অতিরিক্ত আদরে মানুষের পরিবর্তনে অমানুষ তৈরি হয়। একটা কথা শোন অতিরিক্ত রাগ, ভালোবাসা দিয়ে বাবা হওয়া যায় না। “বাবা হওয়া ততটাও সহজ না”।
লেখক: মো: তহিদুল ইসলাম তাপস
তরুণ বিজ্ঞানী ও পরিবেশ পদক প্রাপ্ত।
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ফেসবুক ক্লিক করুন
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ইউটিউব ক্লিক করুন
[শিশুরাই তুলে ধরবে শিশুদের অধিকারের কথা, আপনিও লিখুন আপনার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]]
Comments are closed.