‘উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে—
‘আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর’।’
চরণগুলো কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতা থেকে নেওয়া। ছোটবেলায় আমাদের পাঠ্য ছিল কবিতাটি। কবিতাটি পড়তে পড়তে কতবার নিজেকে ওই শিক্ষার্থীর জায়গায় কল্পনা করেছি। বাদশাহ আলমগীরের নাটকীয়তায় মুগ্ধ হয়েছি। শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়েছি। বড় হয়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি।
আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষক ছিলেন নানা, দাদা ও মামাও। তারা চেয়েছিলেন আমরাও শিক্ষক হবো। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেব সমাজে। তবে আমরা সবাই শিক্ষক হইনি। হতে পারিনি। ছয় ভাইয়ের এক ভাই শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত। বাকিরা বর্তমানে শিক্ষক হওয়ার যে প্রক্রিয়া, তা উৎরে যেতে পারিনি। আমি লেখক হয়েছি, সাংবাদিক হয়েছি। হয়তো আলো ছড়ানোর অভিনব পথে হাঁটছি। তারপরও রাস্তায়, বাজারে, অফিসে, কোলাহলে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার শিক্ষককে দেখলে এখনো চমকে উঠি। ছাত্রজীবনের মতো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠি।
পেশাগতভাবে শিক্ষক হতে না পারলেও একসময় আমিও কিছুদিন শিক্ষকতা করেছি। লজিং, কিন্ডার গার্টেন, কোচিং সেন্টার, ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা করেছি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কারো কারো সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে। আমার প্রিয় কোনো ছাত্রকে আমি বখাটে হতে দিইনি। তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশেছি। তার হতাশায় সান্ত¦না দিয়েছি। সফল হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছি। শিক্ষকরা তো এমনই হয়। জীবন গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ছাত্রের মেধা ও দক্ষতা আবিষ্কার করেন। অন্যায় পথে পরিচালিত না হতে নির্দেশ দেন।
নড়াইল কিংবা সাভারের আশুলিয়ার শিক্ষকও হয়তো তা-ই চেয়েছিলেন। তারা চেয়েছিলেন, ছাত্ররা মানুষের মতো মানুষ হবে। শিক্ষকদের মুখ উজ্জ্বল করবে। আদর্শ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু শিক্ষক চাইলে তো আর হবে না। সাথে সাথে ছাত্রের পরিবারকেও চাইতে হবে। কারণ পারিবারিক শিক্ষা ও শাসনের অভাবে ছাত্ররা বখাটে হয়ে যায়। অপরাধীর পরিবার চায় তার ছেলেকে গ্রামের সবাই ভয় পাবে। এমনকি এলাকার শিক্ষকও। ফলে একদিন শিক্ষকের গলায় জুতার মালা দিয়ে অপমান করে। আবার কখনো শিক্ষককেই স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা আমাদের সাময়িক নাড়া দিয়েছে হয়তো। সাময়িক বলার কারণ হচ্ছে, কয়েকদিন পরেই আমরা এসব ভুলে যাবো। ভুলে যেতে বাধ্য হবো। আবার অন্য কোনো ইস্যু নিয়ে সরগরম হবে চায়ের দোকান, সোশ্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন ও পত্রিকার পাতা। কিশোর অপরাধ বা কিশোর গ্যাংদের এই দৌরাত্ম্য সমূলে ধ্বংস করার কোনো উপায় কি আমরা আবিষ্কার করেছি? আইনের আওতায় আনার কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ কি নিতে পেরেছি? অপরাধী কিশোর বলে শাস্তির পরিমাণও হয়তো কমে যাচ্ছে। তাকে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হচ্ছে। কিশোরটি যখন শাস্তির আওতা থেকে বের হয়ে আসে, তখন কার্যত তার মানসিক বিকাশ অন্য স্বাভাবিক মানুষের মতো হবে না। অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ জনতার আড়ালে সংঘবদ্ধ অপরাধীদের মানসিকতাই কি পরিবর্তিত হবে? গণঅপরাধের সাজাই বা কতটুকু কার্যকর হতে পারে?
আমরা জেনেছি, প্রথম ঘটনাটি নড়াইলের। নড়াইলে একজন অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরানোর ঘটনায় কার কতটুকু গাফিলতি তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে এভাবে হেনস্তার ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছেন আইনজীবী পূর্ণিমা জাহান। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, মহানবি হজরত মুহাম্মদকে (সা) নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যকারী ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রের ফেসবুকে পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলেন ওই কলেজের ছাত্র ও স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা। একই ধর্মের হওয়ায় তাকে সাপোর্ট দিচ্ছে—এমন অভিযোগ তুলে স্থানীয়রা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেন। এ সময় তাদের পাশে পুলিশের অবস্থান দেখা গেছে। ওই শিক্ষককে জুতার মালা পরানোর ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হচ্ছে। প্রতিবাদ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রশাসনের সামনে এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ায় নড়াইলের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারের (এসপি) বিচার দাবি করেছেন বিক্ষোভকারীরা।
দ্বিতীয় ঘটনা হচ্ছে—সাভারের আশুলিয়ায় ছাত্র আশরাফুল আহসান জিতুর স্ট্যাম্পের আঘাতে উৎপল কুমার সরকার (৩৫) নামে এক শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। অভিযুক্ত দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। নিহতের ভাই অসীম কুমার সরকার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি মেয়েদের ইভটিজিংসহ নানা উচ্ছৃঙ্খল আচরণের কারণে শাসন করায় ওই ছাত্র আমার ভাইকে হত্যা করেছে।’ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সাভারের শিক্ষক উৎপল হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি সেই ছাত্রের বাবা উজ্জ্বলকে গ্রেফতার করেছে আশুলিয়া থানা পুলিশ। ২৮ জুন রাত সাড়ে ১২টার দিকে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২৯ জুন সকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) এমদাদুল হক। এ ছাড়া ২৯ জুন সন্ধ্যায় গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকা থেকে হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি আশরাফুল আহসান জিতুকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন বিচার প্রক্রিয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আশা করি আমরা ন্যায় বিচার পাবো।
গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারলাম, শিক্ষককে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা জিতুর বয়স ১৬ বছর উল্লেখ করা হয়েছে। তার মানে জিতুর বয়স আঠারোর নিচে। একটি শঙ্কা তাই রয়ে যায়, আঠারোর নিচে হলে জিতু কিশোর। ফলে কিশোর অপরাধের সাজা কী হতে পারে? দেশের আইনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। আইনের ৩৩/৩৪ ধারামতে, কিশোর অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং কারাদণ্ড প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের উদ্ভব ও বিস্তার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। আইনের বিভিন্ন ধারাকে কিশোর অপরাধ দমনে অন্তরায় বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথম শিশু আইনটি ছিল বেঙ্গল চিলড্রেন অ্যাক্ট, ১৯২২। সেটি রহিত করে হয় শিশু আইন, ১৯৭৪। সম্প্রতি সেটি রহিত করে কিছু পরিবর্তনসহ শিশু আইন, ২০১৩ প্রণীত হয়েছে। আইনে ‘শিশু’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে অনূর্ধ্ব-১৮ বছর পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু গণ্য হইবে।’ তাহলে জিতুকে কি সংশোধনাগারে পাঠানো হবে? আমরা যে শিক্ষককে হারিয়েছি, তাকে আর ফিরে পাবো না জানি। জিতুকেও আর ফাঁসির মঞ্চেও হয়তো দেখবো না। তাই বলতে চাই, এমন ঘটনা নিয়ে আর যেন লিখতে না হয়।
আজ চারিদিকে শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হচ্ছেন। কোথাও কোথাও জীবন হারাচ্ছেন। এ ব্যর্থতা আসলে আমাদেরই। আমরা শিক্ষকদের করেছি সস্তা। আর বাদাম-চিপস বিক্রেতাকে করেছি মহান। কর্পোরেট দৌরাত্ম্যে নীতিগত শিক্ষার অবমূল্যায়ন শুরু হয়েছে অনেক আগেই। বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষকের বেতন ওই কোম্পানির একজন সেলসম্যানের বেতনের অর্ধেক। টাকার গরমে গ্রামের উঠতি ধনীও শিক্ষককে ধাক্কা মেরে বাজারের বড় মাছটি নিজের ব্যাগে তোলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হন স্থানীয় প্রভাবশালী। কোনো শিক্ষানুরাগীকে করা হয় না মূল্যায়ন। ফলে প্রভাবশালীর অনুসারীরা থোরাই কেয়ার করেন শিক্ষকদের। প্রভাবশালী অভিভাবকও লাঞ্ছিত করেন শিক্ষককে। শিক্ষকের হাতের বেত যেদিন কেড়ে নেওয়া হয়েছে; সেদিনই তিনি অসহায় হয়ে পড়েছেন। ‘শাসন’ আর ‘শাস্তি’ যেদিন বন্ধ হয়ে গেছে; সেদিন থেকেই শিক্ষক লাঞ্ছনার ইতিহাস রচনা শুরু হয়েছে।
একইভাবে বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে, বাজারে, মাঠে শিক্ষকদের মর্যাদা নেই। তাদের জন্য বিশেষ আসন থাকা উচিত। সমাজের প্রতিটি স্তরে শিক্ষকদের জন্য মর্যাদা নিশ্চিত করা জরুরি। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটি দপ্তরে শিক্ষককে সম্মানিত করতে হবে। তাহলেই আমাদের তরুণ প্রজন্ম শিক্ষককে সম্মান দিতে শিখবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিওতে দেখেছিলাম, বিমানের পাইলট তার শিক্ষককে যাত্রী হিসেবে পেয়ে ফুলের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। ককপিটে বসে পাইলট যখন বলছিলেন, ‘আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষককে আজ আমার বিমানের যাত্রী হিসেবে পেয়ে আমি গর্বিত।’ তখন ওই শিক্ষকের চোখে জল দেখেছি। আনন্দে এবং গর্বে কাঁদতে দেখেছি। ভিডিওটি হতে পারে বাস্তব কিংবা সিনেমার দৃশ্য। সেটি কোনো বিষয় নয়। তখন আনন্দে আমার চোখেও জল এসেছিল। আমিও ছোটবেলায় দেখেছি, আমার শিক্ষককে দেখলে আমার শিক্ষক বাবাও পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে যেতেন। কুশলাদি বিনিময় করতেন। আমাকে শাসন করার জন্য তাগিদ দিতেন। তখন শিক্ষকের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যেত।
এখনো আমার শিক্ষকরা আমার খোঁজ নেন। আমার সাফল্যে তারা গর্বিত হন। শিক্ষার্থীদের সাফল্যে তারা চুপিসারে কাঁদেন। নিজেরা কিছু না পেলেও ছাত্রের সফলতায় বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়ান। মানুষকে ডেকে বলেন, অমুক আমার ছাত্র। সে আজ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্পিকার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও দেখেছি শিক্ষকদের কীভাবে সম্মান করেন। বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের গায়ের চাদর ঠিক করে দিয়েছেন। শিক্ষকদের আসলে এভাবেই সম্মান করা উচিত। এর জন্য দরকার পারিবারিক শিক্ষা। সবচেয়ে বেশি দরকার নৈতিক শিক্ষা। আমি চাইবো, আর কোনো ঘটনা না ঘটুক। আর কোনো শিক্ষার্থী আমাদের হৃদয়কে আহত না করুক।
ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ বিচার কামনা করছি। দেশের আইনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা অটুট থাকুক। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক হোক বন্ধুত্বের। শিক্ষক হয়ে উঠুক ছাত্রের অভিভাবক। সমাজে বৃদ্ধি পাক শিক্ষকের মর্যাদা। কবির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমিও বলতে চাই, আজ হতে চির উন্নত হোক শিক্ষাগুরুর শির।
লেখক: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কথাশিল্পী ও সাংবাদিক, জাগোনিউজ২৪.কম।

“ভয়েস অফ হ্যালো”র ফেসবুক ক্লিক করুন
“ভয়েস অফ হ্যালো”র ইউটিউব ক্লিক করুন
[শিশুরাই তুলে ধরবে শিশুদের অধিকারের কথা, আপনিও লিখুন আপনার কথা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]]
Comments are closed.